কালীগঞ্জে ১০৫ বছর পিতার ভাগ্যে একি পরিহাস

প্রকাশিত: ৩:০৪ অপরাহ্ণ, জুন ১৪, ২০১৮

কালীগঞ্জে ১০৫ বছর পিতার ভাগ্যে একি পরিহাস

 

টিপু সুলতান ঃ
যাদের লালন-পালনে আজ আমরা এ পৃথিবী দেখতে পারছি আমরাই আজ আমাদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করছি, যা বড়ই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। যা আমাদের সমাজে আগে ছিল না তা এখন শুরু হয়েছে। তা হচ্ছে পিতা-মাতা যখন বয়স্ক হয়ে পড়েন তখন ছেলে-মেয়েরা তাদের ‘বোঝা’ মনে করেন। অনেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে পিতা-মাতাকে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন। এতে পিতা-মাতা যে কষ্ট পান তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অনেকে নিজের কাছে পিতা-মাতাকে না রেখে দেশের বাড়ি অথবা কোনো প্রাইভেট নিবাসে বা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেন। যখন পিতা-মাতাকে সেবা করা প্রয়োজন, আর পিতা-মাতারা যখন বয়সের ভারে কোনো কাজ করতে পারেন না তখন তাদের ছেলে-মেয়েরা সাধারণত আর মূল্যায়ন করেন না। আমাদের সমাজে এ ধরনের প্রচলন আগে ছিল না। যেসব ছেলে-মেয়েকে পিতা-মাতারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন, তারাই বিদেশে চাকরি করার সুযোগে দেশে অবস্থানরত পিতা-মাতাকে দেখাশোনা করতে পারেন না বিধায় অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে বিদেশের মতো বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেন। মাসে প্রয়োজনীয় খরচ পাঠান বা নাও পাঠান। তবে ইদানীং অনেক পরিবারে শান্তি বজায় রাখার অজুহাতে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের চাপে গৃহকর্তা তার বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখেন না এমনও দেখা যায়। পিতা-মাতার যদি সম্পদ থাকে তাও অনেক ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে লিখে নিয়ে পিতা-মাতাকে তাদের মর্যাদা দিতে ভুলে যান। আল্লাহ শক্তি ও সুযোগ দেন যেন কোনো পরিবারে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাকে কেউ অবহেলা না করেন। এতে তাদের কষ্ট কখনো বৃথা যায় না। সে বিষয়টা ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবাইকে আজ অনুধাবন করতে হবে। পিতা-মাতা বহু কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন তাই কোনোভাবেই তাদের মনে কষ্ট দেয়া উচিত হবে না। আসুন যাদের পিতা-মাতা বেঁচে আছেন তাদের একটু হলেও সেবা-যতœ নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ এ পৃথিবীতে পিতা-মাতার চেয়ে বড় কিছু নেই। নিজের সামর্থ্য থাকলে কোনোমতেই পিতা-মাতাকে যেন কোন দিকদিয়ে কষ্ট না দিই। আমাদের কারো দ্বারা যাতে বৃদ্ধ ও বয়স্ক লোকদের কখনো অবহেলা বা অশ্রদ্ধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখি।
এমনই এক অসহায় পিতার দেখা গেল ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার রায়গ্রাম ইউনিয়নের গুমরাইল গ্রামের ঠাকুর পাড়ায়। নাম বঙ্কেশ কুমার পাল, বঙ্কেশ পালের জন্ম ১৯১৩ সালে। বর্তমান বয়স ১০৫ বছর। পেশায় ছিলেন কুমার (মাটির হাড়ি পাতিল তৈরীর কারিগর)। বঙ্কেশের ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে। ছেলে নিমাই সবার ছোট। নিমাই এক ছেলে ও এক মেয়ে, বাবার পেশায়ই আছেন। মেয়েদের সবাইকে বিয়ে দিয়েছেন এবং সবাই শশুর বাড়ীতে বেশ সুখেই আছেন। স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা গিয়াছেন এখন বঙ্কেশের দেখা শোনার মত কেউ নেই তা না, তবে দেখে মনে হলো খুব অবহেলা এবং অনাদরে মৃত্যুর অপেক্ষায় অনেক কষ্টে বেঁচে আছেন। আমরা যেয়ে দেখি বঙ্কেশ বাড়ির খানিকটা দূরে মেহগনি গাছের গোড়ায় ভেজা মাটিতে উলঙ্গ অবস্থায় শোয়ায়ে রাখা হয়েছে। যেখানে কোন কুকুর বেড়ালকেও জোর করে রাখা যাবে না। নড়ার মতো কোন শক্তি নাই ঐ পিতার শ্রবনশক্তি হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু কাউকে দেখলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমাদের দেখে বঙ্কেশ পালের ছেলে নিমাই সাংবাদিক বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি একটা পুরাতন ময়লা চাদর এনে বাবার গায়ের উপর রাখে। বাচড়ায় একটি খেজুরের পাতার পাটিতে বিছানা করে দিয়ে আমাদের জানায় আমার বাবা বিছানায় না থেকে মাটিতে থাকে। আমাদের বুঝতে দেরী হলো না যে এটা মিথ্যা কথা। ঐ অসহায় পিতাকে আমরা যে অবস্থায় দেখেছি তা দেখলে কোন সুস্থ্য মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না আমাদের তার ব্যতিক্রম হলো না। দু’জন তাকিয়ে দেখি অশ্রুসজল চোখ। যাই হোক সামলে নিলাম এবং ছেলেকে বললাম আপনি আপনার বাবাকে এভাবে রেখেছেন কেন ? জবাবে সে জানায় এখন থেকে আর এভাবে রাখবোনা আমাকে কিছু করবেন না। আমি ছাড়া আমার বাবার কেউ নাই। এখন থেকে আমি আমার বাবাকে ঠিকমত দেখাশুনা করবো। আমি আসলে এত গরীব যে কাজ না করলে আমার সংসার চলে না এজন্য আমি আমার বাবাকে ঠিকমত দেখতে পারি না।