আলোকবর্তিকা লেডি অবলা বসু

প্রকাশিত: ১০:৫৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০১৮

মহান বিদ্যাসাগরের জন্মের ৪৫ বছর পর এবং মহীয়সী বেগম রোকেয়ার জন্মের ১৫ বছর আগে আমাদের দেশে জন্ম নিয়েছিলেন আরেক বিস্ময় নারী। বিজ্ঞানাচার্জ জগদীশচন্দ্র বসুর একান্ত সঙ্গী লেডি অবলা বসু। স্বামী বসুর পাশাপাশি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনিও নিজের কর্মজগতে বিচরণ করেছেন এবং নিজের বলয়ে তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য উজ্জ্বল। ক্ষণজন্মা এই নারী নিজের সব জীবনীশক্তি দিয়েই বুঝেছিলেন, নারী ও শিশুদের জীবনের অন্ধকার দূর করার মধ্যেই নিহিত আছে, আমাদের সমাজ ও জীবনের প্রাণশক্তি। বিদ্যাসাগর, অবলা বসু ও বেগম রোকেয়া- প্রায় সমসাময়িককালে জন্ম নেওয়া এই তিন মহান মানুষ, ধারাবাহিকভাবে নারী ও শিক্ষা-সংকট নিয়ে লড়াই করে গেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই জন্মদায় হিসেবেই মনে হয় পেয়েছিলেন নারী লাঞ্ছনা দূর করার দায়ভার। এবং নিজের নিজের ক্ষেত্রেও তাঁরা ছিলেন সভ্যতার সফল কারিগর।

বিদ্যাসাগর কাল ১৮৮০ সেপ্টেম্বর ২৬-১৮৯৬ জুলাই ২৯, অবলা বসু কাল ১৮৬৫ (মতান্তরে ১৮৬৪) আগস্ট ৮-১৯৫১ আগস্ট ২৬ এবং বেগম রোকেয়া কাল ১৮৮০ ডিসেম্বর ৯-১৯৩২ ডিসেম্বর ৯। তাঁদের আবির্ভাব ও কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতা দেখলে মনে হবে, এ যেন সভ্যতা নির্মাণের রিলে রেস। যেন একজনের অসমাপ্ত কাজ অন্যজনে পরম মমতায় বহন করে নিয়ে চলা। স্মরণ করা যেতে পারে, এই তিনজনই নারীর অবরুদ্ধ জীবন ও শিক্ষা-সংকটকে দেখেছিলেন সামাজিক সংকটের কেন্দ্র হিসেবে। অবলা বসুর আগে এবং পরে যে দুজন নারীবান্ধব সৈনিক দেখা দিয়েছিলেন আমাদের এই ধরাধামে, তাঁরা যে নারী জাতির জন্য কতখানি যুধ্যমান ছিলেন, সেই গৌরবময় অতীত প্রতি মুহূর্তে আমাদের আজও রোমাঞ্চিত করে।

তবে আজ আমাদের আলোচনার কেন্দ্র হবে শ্রীমতী বসু। কথাটা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক (!), বিদ্যাসাগরের নারী ও শিক্ষা আন্দোলনের শক্তিশালী উত্তরাধিকার যদি অবলা বসুকেই বলা হয়, তবেই প্রকৃত অবলা বসুকে চিনতে আমাদের সুবিধা হবে। কিন্তু কেন যে তাঁকে অতি যত্নে বাংলার নারী সমাজের কাছে প্রায় অচেনা করে রাখা হয়েছে, তা প্রকৃতই ভেবে দেখার বিষয়। বা কেউ কেউ শুধু বিজ্ঞানী বসুর সহধর্মিণী হিসেবেই তাঁকে দেখতে পছন্দ করেন। অথচ শ্রী বসু এবং তিনি ছিলেন পাশাপাশি চলমান দুই শক্তিধর মানুষ। বেগম রোকেয়া ও অবলা বসুর মধ্যে বয়সের পার্থক্য মাত্র ১৫ বছরের। প্রায় সমসাময়িক সময়েই এই দুই দিকপাল শহর থেকে গ্রাম এবং গ্রামান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন নারী সমাজকে অন্ধকারমুক্ত করতে, ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নারী সমাজের শৃঙ্খল মুক্তির মহাযজ্ঞে। যখন মহীয়সী বেগম রোকেয়া এক হাতে বই-কলম এবং অন্য হাতে আলোর মশাল নিয়ে ছুটে চলেছেন বিরামহীন। তখন আলোকময়ী অবলা বসুও এক হাতে বই-কলম এবং অন্য হাতে আলোর মশাল হাতে সমান গতিতে ছুটে চলেছেন বাংলার পথেপ্রান্তরে। একের পর এক তিনি গড়ে তুলেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার সংখ্যা হবে দুশর ওপরে। অবলা বসুর অসাধারণ এই কীর্তি আজও আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়। অবশ্য বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, এই সময়কাল পর্যন্ত আমাদের দেশে মহাজাগরণ উঠেছিল শিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলনের। সে আজ আমাদের কাছে শুধুই সুখস্মৃতি। বিশেষ করে নারী মুক্তি আন্দোলনের গৌরবময় সেই ধারাবাহিকতার আজ নির্মম ছন্দপতন যে ঘটেছে, তা আমরা আমাদের জীবন দিয়ে প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করছি।

আমাদের দেশের শিক্ষাকে পরিণত করা হয়েছে ধনী সমাজের বিলাসী সামগ্রীতে। একবিংশ শতাব্দীর অধিকার সচেতন এই যুগেও আমাদের বাল্যবিবাহের কাছে করতে হচ্ছে নিষ্ঠুর আত্মসমর্পণ এবং তা আইনসম্মতভাবে! আজও আমাদের দেশের মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে পিতৃ সম্পত্তি থেকে। অথচ ঠিক এর দেড় শ বছর আগে বাংলার আকাশে উদয় হয়েছিল অবলা বসু নামের উজ্জ্বল নক্ষত্রের। যিনি জীবনের সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে। কিন্তু আমরা, সেই অবলা বসুর স্বপ্নের দেশেই আজও হামাগুড়ি দিচ্ছি নিকষ কালো অন্ধকারে! এই দুঃখজনক রহস্যের উৎস কোথায়? তা অনেকটা গবেষণারই বিষয়! যা-ই হোক ফিরে আসি অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর পথযাত্রী অবলা বসুর কাছে।

বিক্রমপুরের বিখ্যাত দাশ পরিবারের সন্তান, নারী সমাজের পথিকৃৎ লেডি অবলা বসুর জন্ম ৮ আগস্ট ১৮৬৫ (মতান্তরে ১৮৬৪) বরিশালে। বাংলা ১২৭১ সালে। পদ্মার গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বিক্রমপুরের ছোট্ট গ্রাম তেলিরবাগের দুর্গামোহন দাশ, যিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অন্ধকার সমাজের বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন যোদ্ধা। বহু বিবাহ বন্ধ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন ও নারী শিক্ষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যোগ্য উত্তরসূরি। ব্রাহ্ম সমাজের মুখপাত্র এই দুর্গাদাশেরই মেয়ে লেডি অবলা বসু। অবলা বসুর মা শ্রীমতী ব্রহ্মময়ী দাশ অবরুদ্ধ নারী সমাজের অন্ধকার দূর করতে, নিজের স্বকীয়তা নিয়ে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ছিল তাঁর আপসহীন পদচারণ।

শ্রীমতী বসুর ভাই তৎকালীন প্রখ্যাত অ্যাডভোকেট জেনারেল সতিশ রঞ্জন দাশ। বোন ‘গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলের’ প্রতিষ্ঠাতা সরলা রায়। গোপাল কৃষ্ণ গোখলে (গোখলে) এখানে কিছু আলোচনার দাবি রাখে। গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ছিলেন ভারতীয় হিসেবে কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি। তবে তার থেকেও তাঁর বড় পরিচয়, তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি নিয়ে ১৯১০ সালে প্রথম সরব হয়েছিলেন। নারী সমাজকে তখন ১০ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হতো। গোখলেই প্রথম নারীদের এই প্রাপ্ত বয়স নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। সম্ভবত সেই কারণেই, বিদুষী দুই বোন, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারী ও শিক্ষাবান্ধব গোখলের নাম জড়িয়ে নেন।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও ভারতের পঞ্চম মুখ্য বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশ ছিলেন অবলা বসুদের নিকটাত্মীয়। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বরিশালে। বরিশালেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন কলকাতার বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে এবং পরবর্তী সময়ে বেথুন স্কুলে। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় ও বেথুন স্কুলের তিনি ছিলেন প্রথম ছাত্রীদের অন্যতম। তিনি ১৮৮১ সালে ২০ টাকা বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বাবা দুর্গামোহন দাশের ইচ্ছা, মেয়ে অবলা ডাক্তার হবে। তৎকালীন কলকাতায় নারীদের ডাক্তারি শিক্ষার সুযোগ না থাকায়, অবলা বসু ১৮৮২ সালে মাদ্রাজে যান ডাক্তারি পড়তে। অসুস্থতাজনিত কারণে শেষ পর্যন্ত ডাক্তারি পড়া তাঁর আর হয়ে ওঠে না। ডাক্তারি পাট অসমাপ্ত রেখেই ফিরে আসতে হয় তাঁকে। তবে সেখানে তিনি ডাক্তারিবিদ্যার ওপর দুই বছরের একটি নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করেছিলেন। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি ‘সার্টিফিকেট অব অনার’ দেওয়া হয়েছিল।

অতঃপর ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানাচার্জ জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে অবলা বসু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯১০ সালে লেডি অবলা বসু ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি স্কুলটি পরিচালনা করেন। নতুন করে সাজিয়ে সেই স্কুলটিকে তিনি করে তুলেছিলেন আরও গতিশীল। একই সঙ্গে দিদি সরলা রায়ের পাশে দাঁড়িয়ে, গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলটি প্রতিষ্ঠার কাজে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে নিজেকে যুক্ত করেন।

লেডি অবলা বসু ১৯১৯ সালে ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই সংগঠনের মাধ্যমে মুরলীধর মহাবিদ্যালয় এবং গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় দুইশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে এসব দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তাঁর সম্বন্ধ শুধু মসির সঙ্গেই নয়, অসি ধরার দুঃসাহসিক কাজেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর সমসাময়িক কালে বিধবাদের দুর্বিষহ জীবন বড় ভাবিয়ে তুলেছিল মহীয়সী এই বঙ্গকন্যাকে। তাই শিক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি বিধবাদের স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বিদ্যাসাগর বাণীভবন’ ‘মহিলা শিল্পভবন’ ও ‘বাণীভবন ট্রেনিং স্কুল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানে বিধবাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে, তাঁদের শিক্ষিত ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলে, তাঁর তৈরি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত বিধবাদের নিয়োগ দেওয়া হতো। পাশাপাশি ‘নারী শিক্ষা সমিতি’র মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজও তিনি পরিচালনা করতেন। যে কাজটা সত্যিই ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এসব বিবেচনায় দেখা যায় বিদুষী অবলা বসু দেহমনেই ছিলেন একজন প্রকৃত মানুষ। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, লেডি অবলা বসু স্বামীর মৃত্যুর পর, তাঁর সঞ্চিত এক লাখ টাকা দিয়ে ‘অ্যাডালটস প্রাইমারি এডুকেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ভগিনী নিবেদিতার নাম।

 

 

দুই
তৎকালীন বাংলার নারী মুক্তি ও নারী শিক্ষা আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে অবলা বসু ছিলেন একটি ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন দুরন্ত মুখ। যাঁর জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা অথচ আজ তিনি আমাদের সমাজে প্রায় অচেনা হিসেবেই পড়ে আছেন! সে সময়কার জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকা মডার্ন রিভিউ-এ নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার ওপর তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্ন বাংলা সাময়িক পত্রিকায় বেরিয়েছিল তাঁর কিছু প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি। অবলা বসুর বিভিন্ন সময়ে লেখা কিছু প্রবন্ধ একটি সংকলনেই পাওয়া যায়-শকুন্তলা শাস্ত্রি প্রকাশিত বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র ও লেডি বসুর প্রবন্ধাবলী নামে। ১৩০২ থেকে ১৩৩২Ñএই সময়কালের মধ্যে মুকুল ও প্রবাসী পত্রিকায় নিজের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, নারী যদি মানুষ হওয়ার সংগ্রাম করেন, তবে তিনি কত উঁচুতে উঠতে পারেন এবং জীবনকেও দেখতে পারেন কতভাবে। ঠিক এইখানটাতে তিনি প্রকৃতই নারী সমাজের অগ্রদূত। বাংলা ১৩০২ অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যার মুকুল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাশ্মীর ভ্রমণকাহিনি। এই কাহিনি শুরুতে অবলা শিশুদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘ইংলন্ড প্রভৃতি সুসভ্য দেশের বালক-বালিকাগণ বাল্যকাল হইতেই ভ্রমণবৃত্তান্ত পড়িতে ভালোবাসে, তাহার সুফল হয় এই যে, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা নূতন দেশ আবিষ্কারের জন্য প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত হয়। আমাদের এই ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠ করিয়া এতটা না হইলেও আশা করি তোমাদের মধ্যে অনেকের মনে নানাস্থান ভ্রমণ করিয়া প্রকৃতির শোভা দেখিবার আগ্রহ জন্মিবে।’

এখান থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে অবলার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করত আমাদের শিশুরা। কীভাবে শিশুদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তা ছিল অবলার জীবনের ধ্যানজ্ঞান। ভ্রমণকেও জীবন গড়ে তোলার উপায় হিসেবে দেখতে পাওয়া, অবলার এই বিচক্ষণতার পরিচয়, তাঁকে চিনতে আমাদের সাহায্য করে। ভ্রমণ, ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের কর্মশক্তির অন্যতম উৎস।
পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরেছেন বিদুষী রমণী অবলা বসু। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু যখন তাঁর বিজ্ঞানের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটছেন বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে। প্রায় সব জায়গাতেই তাঁর সঙ্গী ছিলেন অবলা। এবং অবলার এই ভ্রমণ যে শুধুই স্বামীসঙ্গ ছিল না, তিনি জীবনভর তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে। তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, তিনি ১৯৩২ সালের প্রবাসীতে লিখিত আকারে প্রকাশ করেছিলেন বাঙ্গালী মহিলার পৃথিবী ভ্রমণ নামে। তার এই লেখায় তাঁদের ইউরোপ ভ্রমণের উদ্দেশ্য আমরা বুঝতে পারি। ‘বহুদেশ ভ্রমণে দেশসেবার নানা উপাদান সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি। সে কথা বলিতে গেলে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিতে হয়। সেই বৎসর আচার্য বসু মহাশয় অদৃশ্য আলোক সম্বন্ধে তাঁহার নূতন আবিষ্ক্রিয়া বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রদর্শন করিবার জন্য ব্রিটিশ এসোসিয়েশনে আহুত হন। তাঁহার সহিত আমিও যাই। এই আমার প্রথম ইউরোপ যাত্রা। ইহার পর ৫/৬ বার তাঁহার সহিত পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণে বাহির হইয়াছি। আমার ভ্রমণকালের মধ্যে পৃথিবীর ইতিহাস নানাভাবে ভাঙ্গিয়াছে ও গড়িয়াছে, এক আমার বয়সেই ইউরোপে কত কত পরিবর্তন দেখিলাম।’

ভারতীয় বিজ্ঞানের আধুনিক ধারাকে, অক্লান্ত পরিশ্রমে পশ্চিমা দুনিয়ায় পরিচিত করে তুলেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। এই উপলক্ষেই তাঁদের ইউরোপ ভ্রমণ। এবং অবশ্যই এই ভ্রমণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে তাঁদের এই ভ্রমণ আজও চেতনার গভীর থেকে আমরা দেখতে পেরেছি বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবলা বসুর বয়ানে বরং কিছুটা বুঝে নিতে পারি সেদিনের তাঁদের সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি। ‘এতকাল তো ভারতবাসী বিজ্ঞানে অক্ষম এই অপবাদ বহুকণ্ঠে বিঘোষিত হইয়াছে, আজ বাঙালি এই প্রথম বিজ্ঞান সমরে বিশ্বের সম্মুখে যুঝিতে দণ্ডায়মান। ফল কী হইবে ভাবিয়া আশঙ্কায় আমার হৃদয় কাঁপিতেছিল, হাত-পা ঠান্ডা হইয়া আসিতেছিল। তারপর যে কী হইল সে সম্বন্ধে আমার মনে স্পষ্ট কোন ছবি আজ আর নাই। তবে ঘন ঘন করতালি শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, পরাভব স্বীকার করিতে হয়নাই। বরং জয়ই হইয়াছে।’ ভ্রমণের এই সময়কালেই কলকাতায় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা তাঁদের মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল।

অবলা বসু যত ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন, বলা যেতে পারে ‘ইতালির লুপ্তনগরী’ তাঁর সেরা বিদেশ ভ্রমণকাহিনি। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহর ‘পম্পেই নগরী’ অবলা বসুর মনে ঝড় তুলেছিল। একবার-সারা দিন সেই মৃত নগরী ঘুরে, সন্ধ্যায় শেষবারের মতো শহরটার পানে চেয়ে, তাঁর কল্পনায় ভেসে উঠল, ‘একটি গৃহ ক্রমে ক্রমে ভস্মে ঢাকিয়া যাইতেছিল। সেই গৃহে একটি নারী দুহাতে তার শিশুটিকে উচ্চে ধরিয়া রহিয়াছিল। ভস্মস্তূপ ক্রমে ক্রমে উচ্চ হইয়া দুঃখিনী মাতাকে নিমজ্জিত করিতেছিল। কিন্তু সেই অগ্নির প্রসার হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে হইবে। জ্বলন্ত ভস্মস্তূপ তিল তিল করিয়া দগ্ধ করিয়াও জননীকে একেবারে অবসন্ন করিতে পারে নাই। কী যেন এক মহাশক্তি, দুঃসহ যন্ত্রণা দমন করিয়া রাখিয়াছিল! মাতার হস্ত দুটি মৃত্যু যন্ত্রণাতেও অবশ হইয়া পড়ে নাই। দুই সহস্র বৎসর পরে সেই ঊর্ধ্বত্থিত করপুটে সন্তানটি পাওয়া গিয়াছে। সেই মাতার স্নেহস্পর্শে যেন অতীত বর্তমানের সহিত মিলিয়া গেল। একই দুঃখে, একই স্নেহে, একই মমতায় সেকাল ও একাল, পূর্ব ও পশ্চিম যেন বান্ধা পড়িল! তখন পম্পেইর মৃত রাজ্য সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল, এবং রাজপথ আমার চক্ষে অকস্মাৎ লোকজন পূর্ণ হইল!’

জগদীশচন্দ্র ও অবলার একমাত্র সন্তান জন্মের পরেই মারা যায়। পরবর্তী জীবনে আর কোনো সন্তান তাঁদের জীবনে আসেনি। সমাজের হাজারো শিশুর মাঝে অবলা খুঁজে নিয়েছিলেন সন্তানের অপূর্ণতা। আমরা যে নৈর্ব্যক্তিক মাতৃত্ব-পিতৃত্বের কথা বইয়ে পড়েছি, আশ্চর্যজনকভাবে সেই নৈর্ব্যক্তিক পিতৃত্ব-মাতৃত্বের মহান সৌন্দর্য ধরা দিয়েছিল বসু দম্পতির উচ্চতর মানবিক জীবনে। এখানেও শ্রীমতী অবলা বসু নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন।

অবলা বসুর সৃষ্টিশীল জীবন আমাদের চেতনায় এই বলে প্রতিধ্বনি তোলে, ‘শ্রীমতী অবলা বসু হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতই বাংলার পরমাত্মীয়। একাধারে আমরা তাঁকে পেয়েছি নারী সমাজের যুধ্যমান পথিকৃৎ হিসেবে। অন্যদিকে তিনি ছিলেন শিশু জীবনের কান্ডারি। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি, বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তিনি ক্লান্তিহীন ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর পথে পথে। আবার আমরা দেখি কী পরম মমতায় তাঁর জীবনের পরতে পরতে মিশে ছিল আমাদের সন্তানেরা।

এ কথা না বললেই নয়, বাংলার নারী সমাজের বেদনা দূর করতে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন প্রকৃত সৈনিক রূপেই। আজ এই ঘোর অন্ধকারে, আমাদের অবলা বসুর দিকে ফিরে তাকাতেই হবে। যে দেশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, লেডি অবলা বসু, মহীয়সী বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব ঘটে, সেই দেশের নারী বা শিশুদের জীবনে অন্ধকার কিছুতেই স্থায়ীরূপ পেতে পারে না। আমাদের নারী ও শিশু সমাজের জীবন, মানবিক অধিকারে উন্নীত করার লড়াইয়ে, শক্তিমান অবলা বসু আজ হয়ে উঠুন আমাদের আঁধারের আলো।