আবু ছালেহ্র সেরা হওয়ার গল্প সেরা ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা

প্রকাশিত: ৭:২৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০১৮

শেখ রুহুল আমিন, ঝিনাইদহ  =

বাতায়নের শিক্ষাবিষয়ক পোর্টাল শিক্ষক বাতায়নের সেরা ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা হয়েছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পার-মথুরাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু ছালেহ্ মো. মুছা। এ উপলক্ষে কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র a2i কর্তৃক তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণও মিলছে। এই অগ্রগতিতে স্বাক্ষর রাখছে দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ। প্রযুক্তির ব্যবহার আরও ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চালু করেছে a2i (Access to Information) বা জাতীয় তথ্য বাতায়ন। সেখানে অনেকেই নিজের আগ্রহ আর অদম্য প্রচেষ্টা দিয়ে সরকারের উদ্যোগকে সফল করে চলেছে। বাতায়নের শিক্ষা বিষয়ক পোর্টাল শিক্ষক বাতায়নের সেরা ডিজিটাল কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পার-মথুরাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু ছালেহ্ মো. মুছা। এ উপলক্ষে কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে a2i কর্তৃক তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে সম্মাননা ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউনেস্কোর বিশেষ দূত জনকি পার্ক, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামান ও সংশ্লিষ্ট অনেকেই। আবু ছালেহ্ প্রধানমন্ত্রীর দফতর a2i থেকে নির্বাচিত ঝিনাইদহ জেলার ICT4E জেলা ব্র্যান্ডিং অ্যাম্বাসেডর। একইসঙ্গে আইসিটি মাস্টার ট্রেইনার, যশোর বোর্ডের মাস্টার ট্রেইনার, জেলা ডিজিটাল মেলায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ ও ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং জেলা কম্পিউটার শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এই সফলতা তার এক দিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে তার অনেক পরিশ্রমের গল্প।

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবু ছালেহ্ মো. মুছার জন্ম। বাবার বাড়ি সাতক্ষীরাতে হলেও জন্ম ও ছোটবেলা কাটে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থানার মোবারকগঞ্জে। বাবা মোবারকগঞ্জ সুগার মিলের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় দর্শনার কেরু উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৯৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম তত্ত্ব ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৯৪ সালের কোনো এক দিন মোবারকগঞ্জ সুগার মিল প্রিন্টিং প্রেসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে একটি কাজে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন কম্পিউটারে একজন অপারেটর দ্রুত বেগে টাইপ করে চলেছেন। এটি দেখে তিনি খুবই অবাক হন এবং অনুপ্রাণিত হন লেখার কম্পিউটার চালানোর জন্য। তারপর একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধুর সঙ্গে একটি কম্পিউটার প্রিন্টিংয়ের দোকান দেন। তারা পেন্টিয়াম-১ একটি কম্পিউটার কিনে ঝিনাইদহের এইচএসএস রোডে থানার সামনে দোতলায় ‘এলিট কম্পিউটার’ নামে একটি সেন্টার দেন। শুরু হলো মুছার অন্যরকম পথচলা। একই সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যান। কিন্তু নেশা তার কম্পিউটারে। ধীরে ধীরে কম্পিউটারে তার দখল বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে যুব উন্নয়ন স্বনির্ভর কেন্দ্রে কম্পিউটার ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করেন। তারপর ২০০২ সালে স্থানীয় আলহেরা স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। শিক্ষকতা করতে গিয়ে দেখেন কম্পিউটার বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অনেকেই যথেষ্ট দক্ষ নন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণে গিয়ে প্রশিক্ষকদের দক্ষতা দেখে তার মনে হলো, এই কাজ তিনিও চেষ্টা করলে পারেন। শুরু হলো অধ্যবসায়। কয়েকজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে কম্পিউটার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ‘ঝিনাইদহ জেলা কম্পিউটার শিক্ষক সমিতি’ (এসিটি) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। শিক্ষকদের দক্ষ করার জন্যই মুছার প্রচেষ্টা আরও বেড়ে চলল। শিক্ষা কর্মকর্তাসহ প্রশাসন ব্যক্তিদের নিকট বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তুলে ধরেন নিজের কার্যক্রম। ডাক পেতে লাগলেন বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে। সহকর্মীদের সহযোগিতায় সেসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সফলতা এনে দিল। সরকার শুরু করল ডিজিটাল অগ্রযাত্রা। শিক্ষা অফিসে কম্পিউটার সেট স্থাপন হলে তার কদর বেড়ে যায়। একদম ফ্রি সার্ভিস দিলেন দিনরাত। এর কিছুদিনের মধ্যে শুরু হলো যশোর বোর্ডের অটোমেশন অগ্রযাত্রা। ডাক পেলেন সেখানেও। যশোর বোর্ডের সাব ডোমেইনের মাস্টার ট্রেইনার হয়ে গেলেন। যশোর বোর্ডকে দাঁড় করানোর জন্য সহযোগিতা করতে থাকলেন নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। যশোর বোর্ডের নতুন কার্যক্রমে বহুজনকে ফোনেও সহযোগিতা দিতে থাকলেন।

২০১৪ সালে শুরু হলো ডিজিটাল মেলা। ঝিনাইদহের পুরাতন ডিসি কোর্ট প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মেলায় একটি স্টল নিলেন। মেলায় ডিসি শফিকুর রহমান, সদর থানার নির্বাহী অফিসার জুলকার নয়ন তার কাজ দেখে সুযোগ দিলেন ডিসি অফিস ও নির্বাহী অফিসারের অফিসে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার। পারিশ্রমিক বিবেচনা না করে তিনি নিরলস পরিশ্রম করতে থাকেন। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পেলেন শ্রেষ্ঠ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বাস্তবায়নের জন্য পুরস্কার। জেলা শিক্ষা অফিসের পলাশ শিক্ষাক্রমের ট্রেইনার বানানোর জন্য পাঠালেন ট্রেনিংয়ে। সরকারের শিক্ষাক্রম ও কারিকুলাম টেক্সটবুকের ট্রেইনার হিসেবে নিয়োগ পেলেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসার কামরুজ্জামান তাকে নিয়ে সরকারের ডিজিটাল ক্লাসরুম বাস্তবায়নে নেমে পড়লেন। টিকিউআই-২ এর ট্রেইনার ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম রিফ্রেসার্স ট্রেনিংয়ের ট্রেইনার হওয়ার সুযোগ করে দিলেন এবং ব্যানবেইসের ট্রেইনার হিসেবে নাম সিলেক্ট করলেন। সরকারের ডিজিটাল কার্যক্রম বাস্তবায়নে তার প্রচেষ্টা জোরেশোরে চলতে লাগল। ২০১৬ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পার-মথুরাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। হরিণাকুণ্ডু উপজেলার শিক্ষা অফিসার সুলতান তাকে নিয়ে নতুন উদ্যোগে তার উপজেলায় কাজ শুরু করলেন। সেখানে একটি আইসিটি কার্যক্রমে সক্রিয় হন। আবু ছালেহ্ মো. মুছা জানান, ‘শিক্ষকদের ওয়েব পোর্টাল ‘শিক্ষক বাতায়ন’ এ দেখলাম সেরাদের কার্যক্রম। নেশা জাগল সেরা কনটেন্ট নির্মাতা হওয়ার। চলল প্রচেষ্টা, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে পেলাম শিক্ষক বাতায়নের সেরা হওয়ার সফলতা’। এদিকে ২০১৭ সালে নতুন প্রতিষ্ঠানের হয়ে আবারও স্বীকৃতি পেলেন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বাস্তবায়নের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ডাক পেলেন প্রধানন্ত্রীর কার্যালয়ের ধ২র প্রকল্প থেকে। ভূষিত হলেন ওঈঞ৪ঊ জেলা অ্যাম্বাসেডরের সম্মাননায়। সরকার ভীষণ ২০২১ বাস্তবায়নের সঙ্গী করল। সরকারের ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও নতুন প্লাটফর্ম ‘কিশোর বাতায়ন’ নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।