ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই

প্রকাশিত: ৩:৫৪ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭

ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই

নূরে আলম সিদ্দিকী

 

আজ সারা বিশ্বে যারা মানবাধিকারে ন্যূনতম বিশ্বাস করে, মনুষ্যত্বের প্রতি যারা শ্রদ্ধাশীল, মানুষের মৌলিক অধিকারের মননশীলতায় যারা বিশ্বাসী—তারা সবাই বিস্মিত, উদ্বিগ্ন ও মর্মাহত। যাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তারা সবাই প্রতিবাদমুখর মিয়ানমারের পৈশাচিক, বর্বরোচিত, মনুষ্যত্ব-বিবর্জিত বিভীষিকাময় নৃশংসতার বিরুদ্ধে।

 

 

অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা, গৃহে গৃহে অগ্নিসংযোগ, নারীদের পৈশাচিক ব্যভিচার ও নির্যাতন—সুদূর অতীতের সমস্ত পৈশাচিকতাকে হার মানিয়েছে।   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নািস বাহিনী, মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নিগ্রহও বোধহয় এতখানি বীভত্স ছিল না। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ জঙ্গি-সন্ত্রাসের অমানবিক এবং অযৌক্তিক আক্রমণে বিপর্যস্ত। জঙ্গি-সন্ত্রাসের থাবা থেকে দেশকে বিমুক্ত করার জন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশকে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। গণতন্ত্র ও মুক্ত অর্থনীতির পাদপীঠ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কম ঘটেনি। যুক্তরাজ্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও জঙ্গি দমনে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তারা তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলে অভিযান চালানোর প্রাক্কালে আশপাশের সব নাগরিককে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়। তাদের জঙ্গি-সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহে ও সংশয় সৃষ্টি করে দেশত্যাগে বাধ্য করে না। কিন্তু মিয়ানমারে আজ এ কী নিষ্ঠুর বর্বরতা! ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যেখানে নোবেল-জয়ী সু চি; তখন সু চির প্রত্যক্ষ সমর্থন ও মদদপুষ্ট সেনাবাহিনী কর্তৃক এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, ব্যভিচার, পরিকল্পিতভাবে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। সু চি যেখানে সামরিক জান্তার সহায়তায় দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সেখানে এরকম একটি অকল্পনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এবং এটি পরিকল্পিতভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বংশ-পরম্পরায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের কেবল মুসলমান বলে এই নিপীড়ন, নির্যাতন, নিগ্রহের মাধ্যমে উচ্ছেদ বা নির্মূল করতে চাচ্ছে। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী সংগঠনের পর্যবেক্ষণ এটি। এই হত্যাকাণ্ড ও উচ্ছেদপর্ব সম্পন্ন করার জন্য তারা এতটাই নিষ্ঠুর, বেপরোয়া ও বদ্ধপরিকর যে, কোনো বৈদেশিক সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে মিয়ানমারে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সিএনএন, বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোও কোনোভাবেই সেখানে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। শুধু মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদ মাধ্যমগুলোকে সংবাদ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকরা যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং যাদের কাছ থেকে করছেন, তারাও তাদের পরিবার বা খুব বেশি হলে প্রতিবেশী দু-একজনের দুর্দশার কথাই বলতে পারছেন। সামগ্রিক অবস্থাটা যথাযথভাবে উপস্থাপন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

 

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে যে নির্যাতন-নিগ্রহ অব্যাহত রেখেছে, তাতে সু চির পূর্ণ সমর্থন আজ বিশ্ববাসীর কাছে মর্মান্তিক ও হিংস্র পাশবিকতার একটি উদাহরণ। বাংলাদেশ সরকার ঘরহারা স্বজনহারা সন্তান-সন্ততিহারা ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রচণ্ড ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও যে আশ্রয় দিয়েছে, সেটি জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। কেউ কেউ একে মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত, এমনকি দুঃসাহসিক কাজ বলেও অভিহিত করেছেন। এটা শুধু সরকারের নয়, দেশের সর্বস্তরের জনতার মানবতার প্রতি অভূতপূর্ব দরদের বহিঃপ্রকাশ। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য, এ বছর বন্যায় সিলেটের হাওরাঞ্চল থেকে শুরু করে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং সম্প্রতি জামালপুর, গাইবান্ধা হয়ে কুড়িগ্রাম দিনাজপুর পর্যন্ত আরও ২৬টি জেলায় মারাত্মক বন্যায় ফসলের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, মাটির ও বেড়ার ঘরগুলো যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে—তা সামলানো সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী এবং সার্বিকভাবে প্রান্তিক জনতার জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু তারা রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে নির্বিকার নয় বরং উদারচিত্তে আশ্রয় দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করছে না। সারা বিশ্ব বিস্ময়াভিভূত হয়ে অনুধাবন করছে—প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দারিদ্র্য কবলিত, অন্যতম জনবহুল বাংলাদেশ শুধু আজকের বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধ করেনি; সহস্র বছরের ইতিহাসে এটি একটি অনবদ্য মানবিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটি প্রমাণ করে, আমরা দারিদ্র্য কবলিত হতে পারি, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ বসবাস করে; তবু সারা বিশ্ব দেখল মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো কী অভূতপূর্ব তাদের মানবতাবোধ! বাংলার মানুষ শঙ্কাহীন দ্বিধাহীন উদারচিত্তে আর্ত-মানবতার সেবায় কখনো যে কুণ্ঠাবোধ করেনি, এটি তারই গৌরবদীপ্ত আরেকটি দৃষ্টান্ত। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষের মহামিলনের পীঠস্থান এই বাংলাদেশ। ধর্ম-গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি। আমাদের সংস্কৃতি সব সময় মানবতার উদাত্ত বাণীকেই উচ্চকিত করে। শুধু এই শতাব্দীতে নয়, বহু প্রাচীনকাল থেকে অনেক হিংস্র-লোভাতুর গোত্রের শ্যেন দৃষ্টি বাংলার আকাশ ও মাটির ওপর পড়েছে। অনেক সময় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে আমাদের বার বার ঘুরে দাঁড়াতে হয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আঘাত যত প্রচণ্ডভাবেই আসুক না কেন, আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই মিলে সেই আঘাতকে শুধু সহ্যই করি না, প্রতিঘাত এবং প্রতিরোধ করতে পেরেছি। দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিপীড়ন-নির্যাতন যত ব্যাপক ও ভয়াবহ হোক না কেন, অনাদিকাল থেকে এবং সুদূর অতীতেও আমরা বিজয়ী হয়েছি।

 

 

কথাগুলো উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, এখন পর্যন্ত সাম্প্রতিককালের পাঁচ লাখসহ প্রায় ১০/১২ লাখ (এর আগে বিভিন্ন সময়ে আসা আরও প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছে) রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়াটা দুঃসাহসিকতা তো বটেই, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি একটা ঝুঁকি গ্রহণের শামিল। এটা আমরা সবাই অবগত, পাহাড়িদের নিজস্ব আবাসভূমির একটা দাবি সব সময় আমাদের একটা চাপ, আশঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রোহিঙ্গাদের বাঁধভাঙা পানির মতো এই অনুপ্রবেশ আমাদের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা থাকলেও মানবতার খাতিরে আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তবে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকতে হবে, বিশ্বজনমতকে সংগঠিত করে এই রোহিঙ্গাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা এবং নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা। ওদের প্রত্যাবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে চীন ও ভারত। এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, ভারতে বিজেপির জায়গায় কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলে রোহিঙ্গা সমস্যাটির উদ্ভবই হতো না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ তো করেননি, বরং মিয়ানমারে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আছে উল্লেখ করে সেটি বন্ধ করার জন্য মিয়ানমার সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে এলেন। যদিও বিগত নির্বাচনে অকল্পনীয় বিজয়ের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তবুও এটা বাস্তব যে, ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অবশ্য পরবর্তীতে জনতার চাপে বিজেপির নীতি ও নরেন্দ্র মোদির বিবৃতি বদলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল একটি বিবৃতি তাদের পররাষ্ট্র সচিবকে দিতে হয়েছে। অন্যদিকে চীন গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করে না। ধর্মের প্রশ্নে তারা প্রায় নাস্তিক। নাস্তিকতা তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি। মিয়ানমারকে আপন প্রভাব বলয়ে রাখায় তাদের সুবিধা অনেক। প্রথমত, বাণিজ্যিক; দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগরের ওপর তাদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের অভিলাষ চরিতার্থ করা।

প্রসঙ্গত অং সান সু চি সম্পর্কে কিছুটা তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। দুই সন্তানের মাতা সু চি এখন বাহাত্তরে পা রেখেছেন। মিয়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চির কন্যা তিনি। ১৯৮৮ সালের গণআন্দোলনে তিনি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে এনএলডি ৮১ শতাংশ আসন পেলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হৈচৈ ফেলে দেয়। বর্তমানে তার দল ক্ষমতায়। স্বামী-সন্তানরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না, তাই নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন, যা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান।

 

 

তার জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি অত্যন্ত চতুর রাজনীতিবিদ। স্বীয় চাতুর্যে সামরিক বাহিনীর কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে তার গভীর সংযোগ ও সখ্যের কারণেই কারারুদ্ধ না হয়ে গৃহবন্দী থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। সু চি গৃহবন্দী থাকাকালীন ’৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হন এবং সে অবস্থাতেই ২০১১ সালে বিরোধী দল এনএলডির সভাপতি নির্বাচিত হন। ওরা পিদিম জ্বেলে খুঁজে খুঁজে কাউকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে না, এর জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়—লবিংয়ের দরকার হয়। সে যাই হোক, বাস্তবতা হলো তিনি নোবেল লরিয়েট। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি বিদ্বেষহীন নির্মোহ মানসিকতা নোবেল বিজয়ীকে অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। সু চি সেটা ধরে রাখতে পারেননি; বরং প্রচণ্ডভাবে মুসলিমবিদ্বেষী এবং সহিংসতার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। এটা অন্য নোবেল লরিয়েটদের লজ্জিত ও মর্মাহত করেছে। তাদের প্রতিবাদমুখর করে তুলেছে। বাংলাদেশের ড. ইউনূস, সাউথ আফ্রিকার প্রধান ধর্মযাজক নোবেল-জয়ী ডেসমন্ড টুটু সু চির এই নির্মমতার কঠোর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন। টুটু সাউথ আফ্রিকার প্রধান ধর্মযাজকের পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তার ভাষায়, শুধু সু চির বর্বরতার প্রতিবাদ করার জন্যই তিনি পুনরায় প্রধান ধর্মযাজকের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। মনে রাখতে হবে টুটু খ্রিস্টানদের ধর্মযাজক। মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার এই বলিষ্ঠ প্রতিবাদ একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাংলাদেশের নোবেল-জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস তীব্র ভাষায় রোহিঙ্গা বিতাড়নে সু চির প্রত্যক্ষ ভূমিকার সমালোচনা করেছেন এবং সমস্যা সমাধানে কিছু দিকনির্দেশনাও প্রদান করেছেন।

 

 

নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সীমান্ত অতিক্রমে বাধা না দিয়ে আশ্রয় প্রদান করায় তা বাংলাদেশের উদার ও অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে তুলে ধরেছে বটে। কিন্তু এ বিষয়টির সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা অতি দ্রুত বৃদ্ধি করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে ছোট্ট দেশ মালদ্বীপের বলিষ্ঠ ভূমিকাকে স্যালুট জানাই। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বলিষ্ঠভাবে এর প্রতিবাদ করলে মিয়ানমারের ঔদ্ধত্য নিঃশেষিত হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু মুসলিম দেশ বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সৌদি আরবের বাদশা সালমান বিন আজিজের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রত্যয়দৃঢ়, সুস্পষ্ট ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। বলাবাহুল্য, ধনাঢ্য দেশ সৌদি আরবের বাদশা হিসেবেই নয়, সালমান বিন আজিজ দুই পবিত্র হারামাইনের প্রধান খাদেম হিসেবে মুসলিম বিশ্বের অঘোষিত প্রধান মোড়ল। অন্যদিকে আমেরিকার সঙ্গে সখ্য ধরে রাখার জন্য তার প্রচেষ্টা সর্বজনবিদিত। এই তো কিছু দিন আগেই মুসলিমবিদ্বেষী, কুখ্যাত ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব সফরে গেলে বাদশা সালমান বিন আজিজ তার মনোতুষ্টির জন্য ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছেন এবং ১২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের উপঢৌকন প্রদান করেছেন।

 

 

পৃথিবীর সব দেশের সমগ্র মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশা, বাংলাদেশে প্রবেশ করা ছিন্নমূল রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষায় তিনি ব্যাপকভাবে সাহায্য নিয়ে তো আসবেনই, বরং রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নিজ আবাসভূমিতে প্রত্যাবর্তনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ, বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে তার যে সখ্য, সেটাকে কূটনৈতিকভাবে পুরোপুরি কাজে লাগাবেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে চীনের রপ্তানি বাজার এতটাই বিস্তৃত যে, তাদের থেকে কার্যকর রাজনৈতিক চাপ এলে চীনও মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে শর্তহীন সমর্থন দেওয়ার প্রশ্নে সংযত হতে বাধ্য হবে। তবে বিষয়টিকে আন্তরিকভাবে নিতে হবে। দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও তার পৃষ্ঠপোষক সু চিকে মুসলিম বিতাড়নের তৎপরতা থেকে বিরত রাখা যাবে না; এবং বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের সসম্মানে পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে দেশে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হবে না। আমরা সালমান বিন আজিজকে স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দিতে চাই, এ ব্যাপারে তার দৃঢ় পদক্ষেপের গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে তাকে একদিন এ জন্য চরম মূল্য প্রদান করতে হবে।

 

 

বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হলে চীন ভেটো দেওয়ার কথা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে চীনকে নিবৃত্ত করার জন্য কূটনৈতিক লবির মাধ্যমে সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বিশেষ করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধভাবে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মুসলিম উম্মাহ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের চীনকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে হবে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের অপচেষ্টা করলে একযোগে মুসলিম উম্মাহ চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবে। মুসলিম উম্মাহর কার্যত এ ধরনের শক্ত ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে মিয়ানমারকে মদদ দেওয়া থেকে চীনকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করা এবং ভেটো প্রদান থেকে চীনকে নিবৃত্ত করার জন্য অনতিবিলম্বে বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর একটি সম্মেলন হওয়া উচিত। সালমান বিন আজিজকেই এর উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও বাংলাদেশ চরম ঝুঁকি নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে।   সারা বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও জোরালো উদ্যোগ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে সসম্মানে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না।   উপসংহারে আমরা প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে বলতে চাই, যদিও এই বর্বরতার ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই, তবুও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই কেবল রোহিঙ্গাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।