ইভটিজিং কি ?

প্রকাশিত: ১:৫৫ অপরাহ্ণ, মে ৫, ২০১৮

ইভটিজিং কি ?
মোঃ আরিফুজ্জামান
ঝিনাইদহ।
=
ঝিনাইদহে ইভটিজিং-এর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তাই ইভটিজারদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আইনের ধারাগুলো জানা আবশ্যক। আসুন, এব্যাপারে বিস্তারিত জানি।

ইভটিজিং কি ?

-ইভটিজিং বলতে কোন মানুষকে বিশেষ করে কোন নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজ কর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোন কিছু ছুঁড়ে দেয়া, ব্যক্তিত্বে লাগে এমন মন্তব্য করা, ধীক্কার দেয়া, তার যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী দেয়া, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা, রাস্তায় হাটতে হাটতে ধাক্কা দেয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেয়া, সিগারেটের ধোয়া গায়ে ছাড়া, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান, ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা, চিঠি লেখা, পথরোধ করে দাঁড়ানো, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি প্রদান ইত্যাদিও ইভটিজিং-এর মধ্যে পড়ে। বর্তমানে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে মোবাইল ফোন এবং ই-মেইলের মাধ্যমেও ইভটিজিং হয়ে থাকে।

ইভটিজিং-এ শুধু কি ছেলেদের দোষ? মেয়েদের কোন ভূমিকা নেই ?

– আমাদের দেশে ইভটিজিং সাধারণত: ছেলেরা মেয়েদের প্রতি করে থাকে। এর কারণ আমাদের সমাজে মেয়েদেরকে ছোট করে দেখার প্রবণতা। যদি পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতো বা মেয়েদের মানুষের সম মর্যাদার মনে করা হতো, তাহলে ইভটিজিং হতো না। আমাদের কৃষ্টি- সংস্কৃতি এ রকম নয় যে মেয়েরা ছেলেদের উত্যক্ত করবে। ছেলেরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও ইচ্ছেমত পোষাক-পরিচ্ছেদ পরতে পারলেও নারীদের এসব ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে অনেকে ইভটিজিং এর প্ররোচনা বলে মনে করেন যা দুর্বল ও দরিদ্র মানসিকতার পরিচায়ক। তবে অনেক সময় ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।

ইভটিজিং সম্পর্কিত কি ধরণের আইন আমাদের দেশে প্রচলিত আছে ?

-ইভটিজিং নিয়ে সরাসরি পৃথক আইন না থাকলেও বিভিন্ন আইনে এ সর্ম্পকে বেশ কিছু ধারা বা অনুচ্ছেদ রয়েছে।

ইভটিজিং বা উত্যক্ততা একটি ফৌজদারী অপরাধ। বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ এবং ২৯৪ আইন অনুযায়ী ইভটিজিং বা উত্যক্ততা বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার জন্য একজন অপরাধীর জেল-জরিমানা হতে পারে। এছাড়া ডিএমপি এ্যাক্টের ৭৫, ৭৬ ধারা অনুযায়ীও এটি একটি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে ‘‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না’’ বলা হয়েছে এবং ৩৬ অনুচ্ছেদে ‘‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে’’ বলা হয়েছে। ফলে কোন নারী যদি রাস্তায় বা কর্মক্ষেত্রে টিজিং-এর শিকার হন তাহলে তা সংবিধানে দেওয়া অধিকার খর্ব বলে ধরে নেয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন আইনেও ইভটিজিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে ‘‘যে ব্যক্তি, অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করিয়া (ক) কোন প্রকাশ্য স্থানে কোন অশ্লীল কার্য করে অথবা (খ) কোন প্রকাশ্য স্থানে বা সন্নিকটে কোন অশ্লীল গান, গাঁথা সঙ্গীত বা পদাবলী গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি যে কোন বর্ণনায় কারাদন্ডে যাহার মেয়াদ ৩ মাস পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডনীয় হবে’’ এই আইনটি প্রয়োগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এই আইন দ্বারা ছোট ছোট ঘটনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব।

বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ ধারা অনুযায়ী ‘‘যে ব্যক্তি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশ্যে কোন মন্তব্য করে, কোন শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে যে উক্ত নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায়, কিংবা উক্ত নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন’’। দন্ডবিধি আইনের এই ধারাটির কার্যকর বাস্তবায়ন হলে ইভটিজিং অনেকাংশে কমে যেত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশেও ইভটিজিং বা উত্যক্ততা বিষয়ে বলা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে ‘‘যদি কেউ কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজদেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যা কোন গৃহ বা দালানের ভিতর থেকে হোক বা না হোক কোন মহিলা দেখতে পায় বা স্বেচ্ছায় কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন নারীকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে বা কোন রাস্তায় বা সাধারনের ব্যবহার্যস্থানে কোন অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোন মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে তবে সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ডে অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।

এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ ধারায় ‘‘সর্ব সমাজে অশালীন বা উশৃংখল আচরনের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০০ শত টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ড’’- শাস্তির বিধান আছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন -২০০০ এর ১০ (২) ধারা অনুযায়ী ইভটিজিং-এর শাস্তির বিধান থাকলেও ২০০৩ সালে সংশোধনের মাধ্যমে এই ধারাটি সম্পূর্ণ তুলে দেয়া হয়েছে। তবে কোন ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোন কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানির প্রত্যক্ষ কারণে কোন নারী আত্মহত্যা করলে তার শাস্তির বিধান এই আইনের ৯ (ক) ধারায় রাখা হয়েছে যা সর্বোচ্চ ১০ বৎসর এবং অন্যূন ৫ বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবে।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ সকল প্রকার যৌন নিপীড়ন এবং যৌন নির্যাতন থেকে শিশুকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। তা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ জাতীয়, দ্বিপাক্ষিক এবং বহু পাক্ষিক সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।‍” এই অনুচ্ছেদে অশ্লীল যৌন আচরণ বা বিষয়বস্তুতে শিশুদের অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে ও পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রকে আহবান জানানো হয়েছে।

পরামর্শদাতা-
মোঃ আরিফুজ্জামান
ঝিনাইদহ।
মোবাইলঃ ০১৭২০ ৫৭৫ ২১৩.