ভোটের হাওয়া : ঝিনাইদহ-১ বিকল্প নেই আওয়ামী লীগে পরিবর্তনের পথে বিএনপি

প্রকাশিত: ৩:৩৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০১৮

মাহমুদ হাসান টিপু, ঝিনাইদহ তাজনুর রহমান, শৈলকূপা

আগামী সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-১ (শৈলকূপা) আসন ধরে রাখতে চাইলে বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের বিকল্প নেই আওয়ামী লীগে। অথচ দল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্তত ১১ জন।

বিএনপির লক্ষ্য আসনটি পুনরুদ্ধার করা। অথচ এ আসনে বিএনপির তিনবারের এমপি, উপজেলা শাখার সভাপতি ও নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুল ওহাব দুদকের মামলায় আট বছরের দণ্ড পাওয়ার পর ইমেজ সংকটে পড়েছে এ দল। এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে বিএনপিতে।

শৈলকূপায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেই তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গ্রুপিং ও সামাজিক দ্বন্দ্ব এত বেশি যে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব সংঘাতে প্রাণহানিও ঘটেছে। আহত হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের উভয় নির্বাচনে এখানে বিএনপির প্রার্থী আবদুল ওহাব এবং ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল হাই সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

এবারও আওয়ামী লীগ থেকে শৈলকূপায় সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, দলের জেলা শাখা সভাপতি আবদুল হাই মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। এ ছাড়াও এ দল থেকে নির্বাচনী গণসংযোগ ও লবিং অব্যাহত রেখেছেন দলের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের মেয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পারভীন জামান কল্পনা, জেলা শাখার সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা তৈয়ব আলী জোয়ার্দার, তার ছোট ভাই শৈলকূপা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও দলের জেলা শাখার সদস্য নায়েব আলী জোয়ার্দার, দলের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির সদস্য প্রাইম ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান মীর সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা ও ঢাকার মিরপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী আজাদুল কবির আজাদ, প্রিয়াংকা গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরামের (আসাফো) কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইদুর রহমান সজল, বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাস, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবেদ আলী, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ বাদশা আলম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী আইন ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের নেতা তরুণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম লিটন আহমেদ।

এ আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক এমপি ও দলের উপজেলা শাখার সভাপতি আবদুল ওহাব গত ৩০ অক্টোবর দুদকের মামলায় যশোরের বিশেষ আদালত থেকে আট বছরের সাজা পেয়ে জেলহাজতে যান। গত ১২ ডিসেম্বর তিনি আপিলে জামিন পেলেও তার ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীই তাকে আর আগের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করছেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই দলে আরও দুই মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ও খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডুর নাম আলোচনায় উঠে এসেছে। তারা দু’জনই জনসংযোগ ও প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। দলের নেতাকর্মীদের মতে, এ ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

জাতীয় পার্টির কেউ এখনও নির্বাচনী প্রচার শুরু না করলেও এ দলের উপজেলা সভাপতি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনিকা আলম প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন।

ঝিনাইদহ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনায়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে তিনবারের নির্বাচিত এমপি আবদুল হাইয়ের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী। শৈলকূপায় তিনি ছাড়া অন্য কেউ মনোনয়ন পেলে আসনটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান দলের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, শৈলকূপায় এমপি হাইয়ের বিকল্প নেই। শৈলকূপা উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শিকদার মোশারফ হোসেন সোনা জানান, ১৯৭৩ সালে নৌকার বিজয়ের পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এ আসন আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ছিল। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দীর্ঘ ২৭ বছর পর আবদুল হাইয়ের জয়ের মধ্য দিয়ে নৌকার পালে হাওয়া লাগে এখানে। একই মন্তব্য করেন দলের উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা আরিফ রেজা মন্নু।

সংসদ সদস্য আবদুল হাই জানান, দল তাকে গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছিল। তিনি তিনবারই নৌকার জয় নিশ্চিত করেছেন। তার সময়ে উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজও হয়েছে প্রচুর। গত ১৪ বছরে এখানে যত উন্নয়ন হয়েছে, ৩৮ বছরেও তা হয়নি বলে জানান তিনি। স্বভাবতই এবারও তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বড় দল হিসেবে আওয়ামী লীগে ছোটখাটো গ্রুপিং বা কোন্দল থাকতেই পারে। অবৈধ সুবিধা না পেয়ে অনেকে গ্রুপিং করে জল ঘোলা করার অপচেষ্টা করছে। তিনি জানান, এ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের দলীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সব তৃণমূল নেতাকর্মী তার সঙ্গে আছেন।

পারভীন জামান কল্পনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন জানিয়ে সমকালকে বলেন, এ আসনে কয়েকবার নৌকার জয় হলেও উপজেলায় দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ নয়। তিনি নেত্রীর নির্দেশে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী চাইলে তিনি নির্বাচন করবেন।

তবে বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে দলে কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগ এনে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা নায়েব আলী জোয়ার্দার বলেন, তিনি ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নব্য আওয়ামী লীগারদের নিয়ে রাজনীতি করছেন। দলের প্রকৃত নেতাকর্মীরা বর্তমানে নির্যাতিত হয়ে তার সঙ্গে রয়েছেন। জনগণ ও দলের স্বার্থে তিনি মনোনয়ন চাইবেন এবং সুযোগ পেলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে অর্জিত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন।

জনগণ তরুণ নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে, তাই তিনি এলাকা থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান ঢাকা মিরপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদুল কবির আজাদ। সমকালকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করছেন। দল তরুণ নেতৃত্ব বেছে নিলে এবং তাকে মনোনয়ন দিলে নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধনে নৌকার জয় হবে বলে মনে করেন তিনি।

দলের জেলা শাখার সদস্য অধ্যক্ষ বাদশা আলমও জানান, তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। তবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবেদ আলী বলেন, প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে তিনি মনোনয়ন পেলে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এলাকার উন্নয়ন ঘটাবেন। আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরামের (আসাফো) কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইদুর রহমান সজল বলেন, সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চা ও জনগণের সেবা করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি ঝিনাইদহ-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাস জানান, ঝিনাইদহ-১ আসনের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। দলকে সুস্থ রাজনীতির ধারায় ফিরিয়ে আনতে তিনি কাজ করছেন এবং মনোনয়ন চাইছেন। আওয়ামী আইন ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম লিটন আহমেদ বলেন, দলনেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

অন্যদিকে ঝিনাইদহ-১ আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওহাব এবারও দল তাকে মনোনায়ন দেবে বলে প্রত্যাশা করছেন। তার মতে, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এ আসনে তার নেতৃত্বে ধানের শীষের জয় অবশ্যম্ভাবী।

বিএনপির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওহাব পরপর দু’বার পরাজিত হওয়ার পর এখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশাগ্রস্ত। এ অবস্থায় তারা আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

বিএনপির অন্য মনোনয়নপ্রার্থী জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু জানান, এলাকার ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীরা তরুণ নেতৃত্ব ও পরিবর্তন চাইছে। আর এই প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন।

 

সুত্র ঃ সমকাল

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ