ঝিনাইদহ- ১, চলছে মনোনয়ন লড়াই

প্রকাশিত: ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮

ঝিনাইদহ- ১, চলছে মনোনয়ন লড়াই

আমিনুল ইসলাম লিটন, ঝিনাইদহ থেকে

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ঝিনাইদহ-১ আসনের রাজনীতি এখন চাঙ্গা। সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং করছেন কেন্দ্রে। গণসংযোগ করছেন পুরোদমে। নিজেদের ছবি সংবলিত পোস্টার- ব্যানার টাঙিয়ে ভোটারদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। শৈলকুপা উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে ঝিনাইদহ-১ আসন। এ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ২,৬৭,৭২৩ জন।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আবদুল ওহাব ৬৩,৬৬৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। তিনি পেয়েছিলেন ৪৬,০২৯ ভোট। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির আব্দুল ওহাব ৭৫,১০৫ ভোট পেয়ে আবারো নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান পেয়েছিলেন ৬৮,৫১৪ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটি বিএনপি’র হাতছাড়া হয়ে যায়। বিএনপি’র আবদুল ওহাবকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের আবদুল হাই ৯২,৬৫২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। এরপর আর আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়নি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবদুল হাই নির্বাচিত হন। এই আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উভয় দলের তৃণমূল পর্যায়ে প্রচণ্ড গ্রুপিং রয়েছে। গ্রুপিং ও সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।

এ আসন থেকে এবার আওয়ামী লীগের ছয়জন ও বিএনপির তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই এমপি। তিনি বলেন, আমি ছাত্র জীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখনো দলকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ এখনো অব্যাহত রয়েছে।

আগামী দিনেও এলাকার উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে চাই। ওদিকে শৈলকুপার সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত কামরুজ্জামান। তিনি ৭০’র নির্বাচনে এমএলএ নির্বাচিত হন। তার মেয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পারভীন জামান কল্পনা বাবার উত্তরসূরি হিসেবে এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন। তিনি এলাকায় দলের বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগকে আরো উজ্জীবিত ও সংগঠিত করার কাজ করে যাচ্ছেন।

এছাড়া প্রিয়াংকা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কেন্দ্রীয় আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম (আসাফো)-এর সভাপতি সাইদুর রহমান সজল এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। শৈলকুপা উপজেলার যুগ্নি গ্রামের সম্ভ্রান্ত মোল্ল্যা পরিবারের সন্তান তিনি। ইতিমধ্যেই গণসংযোগের মাধ্যমে এলাকার সামাজিক দ্বন্দ্ব, হানাহানি, মারামারি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি না করতে এবং এলাকায় শান্তি, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন জয় করে চলেছেন। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের ব্যানারে শৈলকুপায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি শৈলকুপার সন্তান হিসেবে গর্বিত, আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন, আমি এই এলাকার জনমানুষের জন্য কিছু করতে চাই। তাই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এলকার মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। এলাকার মানুষের মাঝে ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। ১৬ কোটি মানুষের নয়নের মণি জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাকে মনোনয়ন দেন, তবে আমি আশা করি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগকে আসনটি উপহার দিতে পারবো। এলাকায় কালচারাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করবো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবো, শিক্ষায় সচেতন করার জন্য চাহিদানুযায়ী যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবো, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করবো, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ করে এই উপজেলাকে বাংলাদেশের মধ্যে একটি মডেল উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলবো। দল যদি অন্য কাউকেও মনোনয়ন দেয় তাহলেও আমি তার সঙ্গেই হাতে হাত মিলিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাবো। নৌকা প্রতীক যাতে এবারো এই আসনটি ধরে রাখতে পারে তার জন্য যা যা করা প্রয়োজন আমি তাই করবো।
শৈলকুপার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক নায়েব আলী জোয়ার্দ্দার। তিনি কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনিও এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী।

এছাড়া ঢাকা মহানগর মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী আজাদুল কবির আজাদও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ করছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি। দলের পক্ষে বিভিন্ন সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। শৈলকুপা এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে এলাকার মানুষের সেবা করতে চাই। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবো, নেত্রী মনোনয়ন দিলে অবশ্যই নির্বাচন করবো।

এ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম দুলালও। তিনি এলাকায় নানা কাজের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি’র দখলে থাকা এ আসনটি ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপর থেকে আসনটি দখল নিতে পারেনি বিএনপি। সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি প্রকাশ্যে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা এখনো পর্যন্ত না দিলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানাভাবে প্রচারণার মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। এখানে বিএনপি’র তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলীয় নেতাদের ওপর যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হামলা-মামলা ও পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনে তারা ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ঘর-বাড়ি ছেড়ে হাজার হাজার নেতাকর্মী এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

এ আসনে বিএনপি’র অবস্থান আগের মতো সংগঠিত নেই। এখানে অনেকটা নড়বড়ে অবস্থায় আছে বিএনপি। এছাড়া দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকায় কেন্দ্রীয় ঘোষিত কর্মসূচি পালনও ঠিকমতো সম্ভব হচ্ছে না। তবে নেতাদের দাবি এলাকায় বিএনপি এখনো সংগঠিত। সাংগঠনিক যে দুর্বলতা ছিল তা কাটিয়ে উঠে আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থীরা আশাবাদী সুষ্ঠু ভোট হলে তাদের হারানো আসনটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবেন।

২০০১ সালের আগে এই আসন থেকে একাধিকবার নির্বাচিত শৈলকুপা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সাবেক এমপি আবদুল ওহাব দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে দীর্ঘদিন এলাকায় যেতে পারেননি। নেতাকর্মীরা নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হলেও তারা দলের কাছ থেকে নিরাপত্তা বা কোনো সহযোগিতা পায়নি। আবদুল ওহাব গত ঈদুল আজহার আগে থেকেই এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। দল আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে এই আসন থেকে তিনিই দলীয় মনোনয়ন পাবেন- এমন আশাবাদ ব্যক্তও করেছিলেন তিনি। সেই ভাবে গণসংযোগও করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত একটি দুর্নীতি মামলায় গত ৩০শে অক্টোবর ৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন যশোর স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক। তিনি কারাগারে থেকে কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আবদুল ওহাব বলেন, ৫ই জানুয়ারি অবৈধ ভাবে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিএনপি’র নেতাকর্মী ও সমর্থকরা নানা ভাবে দমন-পীড়ন ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

তাদের পাশে থেকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। আমি এমপি থাকাকালে এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি সরকারের সময় যে কাজ করেছি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সরকার তা করতে পারেনি। তাই এলাকার সাধারণ মানুষ আমাকে ভালোবাসে। তিনি আশাবাদী সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের হারানো আসনটি আবারো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। তবে শেষ পর্যন্ত আবদুল ওহাব নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা- এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন তার দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।

বিএনপি’র অপর সম্ভাব্য প্রার্থী জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এলাকায় কাজ করছি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নির্যাতন-নিপীড়ন ও হামলা-মামলার ভয়ে দলের কর্মী- সমর্থকরা আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের সংগঠিত করে চাঙ্গা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। দলের মধ্যে গ্রুপিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি’র মতো বড় একটি রাজনৈতিক দলে একটু আধটু নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। একে গ্রুপিং বলা যায় না। তবে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এলাকায় কেন্দ্রে থেকে ঘোষিত সকল সভা-সমাবেশ, আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।

বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ। তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি আশাবাদী দল তাকেই এই আসন থেকে মনোনয়ন দেবেন।

শৈলকুপা উপজেলা জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সভাপতি, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জাতীয় পার্টির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মনিকা আলম এ আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে গণসংযোগ শুরু করেছেন। এবার এ আসনে জামায়াতের কোনো প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে না।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ