ঝিনাইদহের গণমিলনায়তন কেন্দ্র এখন পোকা-মাকড়ের বাসা

প্রকাশিত: ১০:১০ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৭, ২০১৭

ঝিনাইদহের গণমিলনায়তন কেন্দ্র এখন পোকা-মাকড়ের বাসা

দলে দলে নারীরা আসতেন, মিলনায়তনে বসে প্রশিক্ষণ নিতেন। সমাজসেবা অধিদফতরের নির্মিত এই মিলনায়তনগুলোতে বসে নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো গ্রামাঞ্চলের নারীদের। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দেওয়া হতো ঋণ। প্রশিক্ষণ আর এই ঋণ কার্যক্রম অসহায় নারীদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।

এখানে প্রশিক্ষণ নেওয়া অনেক নারী তার অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। এখন এলাকার মানুষের কাছে সেই ২৫ গণমিলনায়তন কেন্দ্র শুধুই স্মৃতি।

মিলনায়তন কেন্দ্রের ঘরগুলো নানাভাবে অপব্যবহার হচ্ছে। কেউ রাজনৈতিক দলের অফিস বানিয়েছেন, আবার কেউ দখল করে নিজের কাজে ব্যবহার করছেন। অনেক স্থানে ভবনগুলোতে পোকা-মাকড় বাসা বেঁধেছে।

ঝিনাইদহ জেলায় নির্মিত সমাজসেবা অধিদফতরের মিলনায়তনের জমিও দখল করে নিচ্ছে এক শ্রেণির দখলদার।

স্থানীয়রা বলছেন, এগুলো এখনও তাদের মনে প্রভাব ফেলে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভূমিকা তারা ভুলতে পারেন না। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা অনেক কিছু করতে সক্ষম হয়েছেন।

তাছাড়া কেন্দ্রগুলোও এতটাই পরিচিত ছিল যে, কোটচাঁদপুরে একটি মিলনায়তনের নামে বাজার গড়ে উঠেছে। সমাজ কল্যাণ বাজার নামে যার পরিচিতি।

ঝিনাইদহ জেলা সমাজ সেবা অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে এ সকল গণমিলনায়তন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ের সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে গণমিলনায়তন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য এলাকার মানুষ জমি দান করেন।

বেশিরভাগ জমিই ছিল ১৫ থেকে ১৬ শতক। সরকার ওই জমির ওপর টিনসেড ঘর তৈরি করেন। এরপর শুরু হয় গ্রামের অবহেলিত নারীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। দলভুক্ত করে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষক ছিলেন সমাজসেবা অধিদফতরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তারা।

এভাবে ঝিনাইদহ জেলায় ২৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়মিত নারীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতো। এর মধ্যে ছিল কোটচাঁদপুরে ১৫টি, মহেশপুরে ৪টি, শৈলকুপায় ৩টি ও হরিনাকুণ্ডু উপজেলায় ৩টি।

সদর উপজেলা ও কালীগঞ্জে কোনো কেন্দ্রে ছিল না। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যারা প্রশিক্ষণ নিতেন তারা সহজ শর্তে ঋণ পেতেন। পরে তা দিয়ে এসব নারীরা আয়বর্ধক নানামূখী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।

সমাজসেবা অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, এই কার্যক্রমটি ছিল একটি প্রকল্পের আওতাভুক্ত। পল্লী মাতৃ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত এই কার্যক্রম তিন/চার বছর চলমান ছিল। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে।

নারীরা আর প্রশিক্ষণ পান না। তাদের মাঝে দেওয়া ঋণ কার্যক্রম চললেও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যারা প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে যুক্ত ছিলেন তারা ওই ঋণ আদায়ের কাজে যুক্ত হন। আর আস্তে আস্তে গণমিলনায়তনগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়। সেখানে থাকা নানা উপকরণ সংরক্ষণ না করায় হারিয়ে গেছে। এখন শুধু ঘরগুলো আছে পরিত্যক্ত, বেদখল অবস্থায়।

সরেজমিনে কোটচাঁদপুর উপজেলার ফুলবাড়ি গণমিলনায়তনে গিয়ে দেখা যায়, ১৬ দশমিক ৫ শতক জমির অনেকটা প্রতিবেশীরা দখল করে নিয়েছেন। ঘরটির একপাশে মমতাজ খাতুন নামের এক বিধবা বসবাস করছেন। আরেক পাশে আছেন আলাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি।

মমতাজ জানান, তার কোনো জায়গা জমি নেই। থাকার মতো কোনো ঘর না থাকায় এখানে থাকেন।

একই উপজেলার হরিন্দিয়া গণমিলনায়তন কেন্দ্রের জায়গায় সরকার দলের অফিস করা হয়েছে।

ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানান, জায়গাটি পড়ে ছিল। তাই তারা ব্যবহার করছেন।

জালালপুর গণমিলনায়তন কেন্দ্রের ১৬ দশমিক ৫ শতক জমির মধ্যে ১২ দশমিক ৫ শতক জমি অন্যরা দখল করে নিয়েছেন। সেখানে পাঁকা ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।

গণমিলনায়তনে প্রশিক্ষণ নেওয়া নারী হরিন্দিয়া গ্রামের জহুরা খাতুন জানান, তিনি সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এরপর সমাজসেবা অফিস তাকে ঋণ দেন, যা দিয়ে সেলাই মেশিন ক্রয় করে কাজ করতেন। এখন আর কাজ করেন না।

আরেক নারী ফুলবাড়ি গ্রামের ছালমা খাতুন জানান, স্বামী মিনহাজ উদ্দিনের একার আয়ে ঠিকমতো সংসার চলত না। এই সমাজ সেবা অফিসের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা পেয়ে আজ পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে।

এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোমিনুর রহমান জানান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো চালু থাকলে নারীরা প্রশিক্ষণ পেতো, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। কিন্তু, এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জায়গা ও ভবনগুলো অন্যরা ব্যবহার করছেন।

খোঁজ-খবর নিয়ে দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানান।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ