ঝিনাইদহের কৃতি সন্তান

প্রকাশিত: ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৬, ২০১৮

ঝিনাইদহের কৃতি সন্তান

ঝিনাইদহের কৃতি সন্তান
ড: খোন্দকার আ.ন.ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ।

অনন্য ব্যক্তিত্ব ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের ইসলামিক পণ্ডিত আর হাদিস বিশারদ। ডঃ খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার ছিলেন বিনয়ী আর উদারতার দৃষ্টান্ত। একজন বড় মনের মানুষ ছিলেন। ‘আলেম কিংবা স্কলার বলতে আসলেই যাদের বোঝায় তাঁদের চমৎকার উদাহরণ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন মতবাদে মুসলিম উম্মাহ যখন নানাভাবে বিভক্ত, যখন সংকীর্ণতা গ্রাস করে দলকেন্দ্রিক বানিয়েছে অনেককেই, যখন কাঁদা ছোড়াছুড়ি খুব আয়েশের ব্যাপার, তখন এই ব্যক্তিটা দূরত্ব ঘুচাতে এগিয়ে এসেছিলেন, প্রান্তিকতা মোছাতে এসেছিলেন। তাঁর কথাতে আল্লাহ্‌ কিছু একটা দিয়েছিলেন। তা যে-ই শুনেছে, মুগ্ধ হয়েছে। খুঁটিনাটি বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে উম্মাহর কঠিন সমস্যাগুলো নিয়ে মানুষটি বেশি বেশি বলে গেছেন, কাজ করেছেন। মতবাদের বিষয় নিয়ে মানুষকে দূরে ঠেলে না দিয়ে কিভাবে কাছে টেনে বোঝাতে হয় সেই উদাহরণ রেখে গিয়েছেন আমাদের সামনে। দেশের যেকোনো অঞ্চলে কাজ করার জন্য মানুষটি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। বিভিন্ন জেলায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অহরহ ছুটে বেড়িয়েছেন মানুষকে দ্বীন ইসলামের সঠিক দাওয়াত পৌঁছে দিতে।
এই মানুষটার বই-লেকচার যতবার পড়েছেন-শুনেছেন ততবারই মুগ্ধ হয়েছেন।তিনার মতে, কাউকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, আমাদের কাজ সকল ইসলামিক ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসা। কারও মধ্যে সামান্য ভুল যদি থেকে থাকে তার মানে এই নয় যে ঐ ব্যক্তির সব কাজকে আমরা তুচ্ছ বানিয়ে নেব। ব্যক্তিটাকে ধুলিস্যাত করে দিব। এই কথাগুলোই শিখিয়ে গেছেন তিনি।

শাইখের পুরো নাম ডঃ খোন্দকার আ. ন. ম. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। তিনি ছিলেন একাধারে ইসলামী চিন্তাবিদ, টিভি আলোচক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট ‘আলেমে দ্বীন, গবেষক ও লেখক। তিনি পিস টিভি, ইসলামিক টিভি, এটিএন ও এনটিভি, চ্যানেল নাইন সহ বিভিন্ন টিভিতে ইসলামের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেল আইটিভি ইউএস-এর উপদেষ্টা ছিলেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, মসজিদের খুতবায় ও টিভি আলোচনায় খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে দেশের সহজ-সরল মুসলমানদের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়গুলো আলোচনা করে জনসচেতনতা তৈরি করে আসছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বিস্তারিত উত্তর প্রদানে পারদর্শীতাই তাঁর জ্ঞানের গভীরতা প্রমাণ করে।

এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের ধোপাঘাট গোবিন্দপুর গ্রামে। তার পিতা খোন্দকার আনওয়ারুজ্জামান ও মা বেগম লুৎফুন্নাহার। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৭৫ সালে আলিম এবং ১৯৭৭ সালে ফাজিল ও ১৯৭৯ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পাস করার উচ্চতর শিক্ষার জন্যে সৌদি আরব গমন করেন। রিয়াদে অবস্থিত ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাঊদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৮৬ সালে অনার্স, ১৯৯২ সালে মাস্টার্স ও ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্র জীবনে তুখোড় মেধাবী হিসেবে পরিচত ছিলেন তিনি। রিয়াদের মুহাম্মাদ বিন সাউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বর্তমান সৌদি বাদশা ও তৎকালীন রিয়াদের গভর্নর সালমান বিন আব্দুল আজিজের হাত থেকে পর পর দু’বার সেরা ছাত্রের পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায, বিন উসায়মিন, আল জিবরিন ও আল ফাউজানের মতো বিশ্ববরেণ্য স্কলারদের সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর রিয়াদ ইসলামি সেন্টারে দাঈ ও অনুবাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

লেখাপড়া শেষ করে ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়া থেকে ইসলামি উন্নয়ন ও আরবি ভাষা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকার দারুস সালাম মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন শায়খুল হাদিস হিসেবেও পাঠদান করতেন। বাংলা ইংরেজি ও আরবি ভাষায় সমাজ সংস্কার, গবেষণা ও শিক্ষামূলক প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি ভাষায় A Woman From Desert (1995), Guidance For Fasting Muslims (1997), A Summary of Three Fundamentals of Islam (1997); আরবি ভাষায় লিখিত আদাবুল হাদিস’ (২০০৭); বাংলায় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো হাদিসের নামে জালিয়াতি, এহইয়াউস সুনান ও কুর’আন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, রাহে বেলায়েত, রোযা, ইসলামের তিন মূলনীতি, একজন জাপানি নারীর দৃষ্টিতে হিজাব, কোরআন সুন্নাহর আলোকে পোশাক ও সাজসজ্জা সহ অনেক মুল্যবান গ্রন্থ। তাছাড়া তিনি মুসনাদে আহমাদ, ইমাম আবু হানিফা রাহঃ রচিতআল-ফিকহুল আকবার এবং ইযহারুল হকসহ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।

ড. আবদুল্লাহ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী, যুগ সচেতন এবং উম্মাহর ঐক্যবিধানে তৎপর একজন মানুষ। “তাঁর কাছেই শিখেছি ভিন্নমতের কাউকে কীভাবে শ্রদ্ধা করতে হয়। বিনয়ের এক অমর শিক্ষক শায়েখ (রা.)কে দেখেই অনুভব করেছি প্রকৃত আলেমের চরিত্র!” ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে এভাবেই স্মৃতিচারণ করে কথাগুলো বলছিলেন শায়খ হাসান জামিল (হফেজাহুল্লাহ)। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। ছেলে ওসামা খন্দকার সৌদি আরবের রিয়াদ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত।

ঝিনাইদহ শহরের গোবিন্দপুরে আল ফারুক একাডেমি ও আস সুন্নাহ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন বরেণ্য এই ইসলামী ব্যক্তিত্ব। সেখানে ছেলেমেয়েদের হেফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব হিসেবে কাজ করেছেন শিক্ষা ও ঝিনাইদহের চ্যারিটি ফাউন্ডেশনে, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইনস্টিটিউটের। আমৃত্যু তিনি ঝিনাইদহ জামে মসজিদ ও কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (৫৫) বছর বয়সে ১১ মে ২০১৬, এক
সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন। সাথে সাথে ঝিনাইদহ বাসি সহ সমগ্র বাংলাদেশ একজন উজ্জল নক্ষত্রকে হারালো।

তথ্যসুত্র,,ইন্টারনেট ও অন্যান্য