ঢাকার কাছাকাছি প্রাচীন কয়েকটি জমিদার বাড়ি

প্রকাশিত: ৫:৫৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১, ২০১৮

ঢাকার কাছাকাছি প্রাচীন কয়েকটি জমিদার বাড়ি

সুজলা, সুফলা, শস্য- শ্যামলা বাংলাদেশের ভূমি। বাংলাদেশের বুক জুড়ে রয়েছে মন হরণ করা প্রাকৃতিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলাদেশের ভূমি অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের পরতে পরতে ঐতিহাসিক স্থান, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও চিহ্ন রয়েছে। অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে এখনো টিকে আছে বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত জমিদার বাড়িসমূহ। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, পূর্বে জমিদার বাড়ির অনেক দাপট থাকলেও বর্তমানে কালের আবর্তে সব হারিয়ে গেছে। রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক নির্মাণ। তবে কিছু কিছু প্রাচীন জমিদার বাড়ি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে রয়েছে। আসুন জেনে নিই অতীত ইতিহাস ও কালের সাক্ষীস্বরূপ ঢাকার কাছাকাছি কয়েকটি প্রাচীন জমিদার বাড়ি সম্পর্কে।

শ্রীফলতলি জমিদার বাড়ি, গাজীপুর

ছবিসূত্রঃ http://www.routeandgo.net

শ্রীফলতলি জমিদার বাড়ি রাজধানী ঢাকার গাজীপুরে অবস্থিত প্রায় দুইশো বছরের পুরনো বাড়ি। এটি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত যা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সুপরিচিত। অন্যান্য জমিদার বাড়ির মতো কালিয়াকৈরের এই শ্রীফলতলি জমিদার বাড়ি বিখ্যাত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার ভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাওয়াল গাজী। ভাউয়াল গাজীরা ৪ ভাই ছিলেন। এর মধ্যে তালেব গাজী নামের একজন নিজ পরিবারের বসবাসের জন্য এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন জমিদার বাড়ির দুটি তরফ ছিল। এখন এই জমিদার বাড়িতে সিনেমা, নাটকের শুটিং চলে। পূর্বে এই জমিদার বাড়ির দাপট, কারুকাজ, হাব ভাব থাকলেও বর্তমানে অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা কেউ কেউ এই বাড়িটিকে ভুতুড়ে বাড়ি বলে থাকে। কারণ রাত বিরাতে ঐ বাড়ি থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পায় স্থানীয়রা। কেউ কেউ মনে করেন, জমিদাররা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তখন স্বর্ণ, গয়না, হীরা ও আসবাব দেয়ালে প্লাস্টার করে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে খোঁজা হলে এর কিছুই পাওয়া যায়নি। তালেব গাজী এই জমিদার বাড়ি নির্মাণ করলেও ছোট তরফের কোথাও তাঁর নাম উল্লেখ নেই। লেখা আছে এই এস্টেটের কর্ণধার নেওয়াজ খান।

মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি, নারায়ণগঞ্জ

ছবিসূত্রঃ http://beautifulplacesofbd.blogspot.com/

শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে নারায়ণগঞ্জের মুড়াপাড়া গ্রামে মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। মুড়াপাড়া গ্রামের নামানুসারে এই জমিদার বাড়িটির নামকরণ করা হয়। এই জমিদার বাড়িটি ১৭.৫০ একর জায়গা জুড়ে ১৮৮৯ সালে রামরতন ব্যানার্জী নির্মাণ করেন। রামরতন ব্যানার্জী ছিলেন নাটোরের রাজার বিশ্বস্ত কর্মচারী। নাটোরের রাজা বিশ্বস্ত কর্মচারীকে সততার পুরষ্কার হিসেবে মুড়াপাড়ায় কিছু সম্পত্তি দান করেন। এভাবে সম্পত্তি পান রামরতন ব্যানার্জী। পরবর্তীতে তার ছেলে বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী জমিদার বাড়িটিকে সম্প্রসারিত করেন।

ছবিসূত্রঃ http://www.panoramio.com

দ্বিতল এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে ৯৫টি কক্ষ। এই কক্ষগুলোর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো নাচঘর, আস্তাবল, মন্দির, কাচারিঘর, ভাণ্ডার ইত্যাদি। জমিদার বাড়িটি ছিল বিশাল আকৃতির। সদর দরজার পাশে খোলা প্রান্তর, আম বাগান, চার ঘাট বিশিষ্ট পুকুর, সবুজ মাঠ, মূল ভবনের পেছনে বিশাল জায়গা জুড়ে উঠান, মন্দির রয়েছে জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে। বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি বনভোজনের স্থান হিসেবে খ্যাত। চাইলে আপনিও পরিবার নিয়ে এই জমিদার বাড়িটি ভ্রমণ করতে পারেন।

বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি, সাভার

ছবিসুত্রঃTourist guide

তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত বিরুলিয়া জমিদার বাড়িটি ঢাকার কাছাকাছি সাভারের বিরুলিয়া গ্রামে অবস্থিত। ভ্রমণ পিপাসুরা ইচ্ছে হলে নাগরিক ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে একদিন সাভারের বিরুলিয়া জমিদার বাড়িটি ঘুরে আসতে পারেন। জমিদার বাড়িটি রাজা রজনীকান্ত ঘোষের এগারোটি প্রাচীন স্থাপনার জন্য বিখ্যাত। জানা যায়, রজনীকান্ত ঘোষ নলিনী মোহন সাহার কাছ থেকে ৮৯৬০ টাকা ৪ আনা দিয়ে এই বাড়িটি ক্রয় করেন। ১৯৬৮ সালের দাঙ্গার সময় রজনীকান্ত ঘোষের স্মৃতি সহ সব লুটপাট হয়ে যায়। এখানে অনেক মন্দির আছে। তবে পূর্বে এই জমিদার বাড়িটি জমজমাট থাকলেও বর্তমানে ধ্বংসাত্মক শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বর্তমানে বিরুলিয়া জমিদার বাড়ি সহ এই গ্রামের আরো অনেক বাড়ি বেদখলে আছে। এই বাড়ির সদরঘর, বিশ্রামঘর, পেয়াদা ঘর, আস্তাবল সহ অন্যান্য ঘর অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জমিদার লক্ষণ সাহার বাড়ি, নরসিংদী

ছবিসূত্রঃ tourtoday.com

ঢাকার কাছাকাছি নরসিংদীর ডাঙ্গা গ্রামে জমিদার লক্ষণ সাহার বাড়ি অবস্থিত। মাধবদী বাজার থেকে অটো রিজার্ভ করে কোনো ঝামেলা ছাড়া ডাঙ্গা গ্রামে যাওয়া যায়। জমিদার লক্ষণ সাহার এই বাড়িটি দেখলে এখনো পূর্বের দাপট, কারুকাজ, হাব-ভাব সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আঁচ করা যায়। পূর্বের জমিদাররা খুব বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। আরাম প্রিয় ও বিলাসী ছিলেন বলেই বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তারা নির্মাণ করতেন সুখের স্বর্গ। কিন্তু কাল বড় নিষ্ঠুর। সকল সুখের স্বর্গই কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যায়; চলে যায় নির্মাণকারীরাও। নরসিংদীর ডাঙ্গা গ্রামে তিনটি জমিদার বাড়ি আছে। ভ্রমণ পিপাসুরা চাইলে একদিন ঘুরে আসতে পারেন জমিদার বাড়ি থেকে।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি, মানিকগঞ্জ

ছবিসূত্রঃ blogspot.com

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন তদানীন্তন লবণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ রাম সাহা। বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি ১৬,৫৫৪ বর্গমিটার জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে সাতটি দালান রয়েছে। প্রতিটি দালান প্রাচীন ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। বর্তমানে বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আছে। এই বাড়িটির বিভিন্ন ভবন উনিশ শতকে অথবা বিশ শতকে রাজারা বিভিন্ন সময়ে স্থাপন করেছেন। তবে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রাসাদ ছিল বালিয়াটি জমিদার বাড়ি। জানা যায় ৭টি দালানের মধ্যে বেশ কয়েকটি দালান ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হতো। আর রাজাদের পরিবার বসবাস করতো অন্দরমহলে।

ছবিসূত্রঃ panoramio.com

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির গেটে সিংহের দারুণ মুর্তি রয়েছে। একটু সামনে গেলেই চোখে পড়ে বিশাল পুকুর। প্রতিটি প্রাসাদের কারুকাজ, বুনন দেখলে কৃষ্টি ও সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি এখন দর্শনীয় স্থান বলে খ্যাত। প্রায় প্রতিদিন এখানে ভিড় জমায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত দর্শনার্থীরা। ঢাকার কাছাকাছি প্রাচীন সভ্যতার উজ্জ্বল নিদর্শন মানিকগঞ্জের বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন।