বঙ্গঁগুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে ঝিনাইদহ

প্রকাশিত: ৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২০, ২০১৮

বঙ্গঁগুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে ঝিনাইদহ
 অনিক সাফওয়ান, ঝিনাইদহ :
ঝিনাইদহ জেলার নামকরণ নিয়ে কোন মতপার্থক্য নেই। নেই পন্ডিতদের মধ্যে বিভেদ। তাই একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন ‘ঝিনুকদহ থেকে ঝিনাইদহ’ হওয়া এই জনপদের বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস। ঝিনুকের আধিক্যের কারণেই এই স্থানটির নামকরণ হয়েছিলো ঝিনাইদহ, যা স্বীকৃত সত্য। ‘দহ’ কথাটির চলিত অর্থাৎ দুয়া বা অগভীর জলাশয়। পূরাকালে ঝিনাইদহের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদীর যত্রতত্র স্থানে এরূপ দহের অবস্থান ছিলো। যাতে বিভিন্ন জাতের ছোট মাছ ও জলজ প্রাণীর সাথে পাওয়া যেতো অসংখ্য ছোট বড় ঝিনুক।
এসব ঝিনুক পুড়িয়ে তৈরী করা হতো চুন। সে সময় নদীর তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছিলো চুনশিল্প। এসব ঝিনুকের মধ্যে আবার পাওয়া যেতো মুক্তা। সে সময় স্থানীয় ভাবে তৈরী মুক্তার অলংকাররের কদর ছিল সর্বত্র। মোট কথা ঝিনুক আর দহ এই দুই কথার মিলন হচ্ছে ঝিনুকদহ। কালক্রমে ঝিনুকদহ থেকে ঝিনাইদহ নামকরণ করা হয়েছে। এখন নবগঙ্গার সেই খর¯্রত রূপ না থাকলেও নদীর বুকে রয়ে গেছে ছোট বড় দহ। ঝিনাইদহ জেলা রেজিষ্ট্রার কার্যালয়ের সামনে এমন একটি বৃহৎ দহ সম্প্রতি খনন করা হয়েছে। সেখানে আর ঝিনুক পাওয়া যায় না। ফলে চুন ও মুক্তা শিল্প’র বিলুপ্তি ঘটেছে। অনেকের মতে ঝিনুককে আঞ্চলিক ভাষায় ঝিনেই, ঝিনাই এবং দহ অর্থ বড় জলাশয় ও ফার্সি ভাষায় দহ বলতে গ্রামকে বুঝানো হতো।
সেই অর্থে ঝিনুকদহ বলতে ঝিনুকের জলাশয় অথবা ঝিনুকের গ্রাম বুঝাতো। আর এই ঝিনুক এবং দহ থেকেই ঝিনুকদহ বা ঝিনেইদহ, যা- রূপান্তরিত হয়ে আজকের ঝিনাইদহ নামকরন হয়েছে। অন্য কিংবদন্তি থেকে জানাযায়, এক ইংরেজ সাহেব এই এলাকা দিয়ে নৌকাযোগে নবগঙ্গাঁ নদী পর হচ্ছিলেন। অনেক লোকজন তখন নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিল। উপস্থিত লোকদের কাছে সাহেব তখন এলাকাটির নাম জানতে চান। লোকেরা তার কথা বুঝতে না পেরে ভেবে নেন যে নদী থেকে তারা কি জিনিস তুলছে তার নাম জানতে চাচ্ছেন। এই মনে করে লোকেরা সাহেবকে বলেন ঝিনুক বা ঝিনেই। এতে ইংরেজ সাহেব ধরে নেন জায়গাটির নাম ঝেনি। এই ঝেনি শব্দটি পরে ঝেনিদা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ঝিনাইদহকে আঞ্চলিক ভাষায় এখনও ঝিনেদা বলা হয়।
ঝেনিদা, ঝিনেদা আর ঝিনাইদহ যাই বলা হোক না কেন ঝিনাইদহ নামের উৎপত্তি যে ঝিনুক থেকে তা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ গ্রন্থে ঝিনাইদহ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘‘বারো আউলিয়ার আর্শীবাদপুষ্ট, গাজী-কালূ-চম্পাবতীর উপখ্যানধন্য, কে.পি. বসু, গোলাম মোস্তফার স্মৃতি বিজড়িত, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, বিপ্লবী বীর বাঘাযতীনের শৌর্যময়, খেজুর গুড়, কলা-পানের প্রাচুর্যমন্ডিত, পাগলাকানাই, লালন শাহের জম্মস্থান, কপোতাক্ষ, বেগবতী, চিত্রা, নবগঙ্গাঁর ঝিনুকদহ এক কথায় নাম তার ঝিনাইদহ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব, কৃষি-মৎস্য, প্রত্নতত্ত্ব ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই জেলাটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অধিকার করে আছে এবং অনেক পূর্ব থেকে এটি সমৃদ্ধি অর্জন করেছে।
ঝিনাইদহ অঞ্চলটি দূর অতীতে তমাশাবৃত, জঙ্গলাকীর্ণ ও কেয়াবন আচ্ছাদিত ছিল। এসময় অঞ্চলটি সুন্দরবনের বর্ধিতাংশ বলে গণ্য হতো। অনেকে এ অঞ্চলকে সুর্যদ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর ইরান-ইরাক-তুরষ্ক ও আফগানিস্থান থেকে অনেক সুফী দরবেশ, পীর-আউলিয়া ধর্ম প্রচারের জন্য ঝিনাইদহে আসেন। তারা এ অঞ্চলের শৈলকুপা, কালীগঞ্জ, বারোবাজার, কোটচাঁদপুর, মহেশপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে আবাস গড়ে তোলেন। জেলার বারোবাজার,  শৈলুকপা, কোটচাঁদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নির্মিত মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপত্যের নিদর্শন আজও পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাধক মরমী কবি লালন সাঁই, পাগলা কানাই, দুদ্দুশাহ, পাঞ্জু শাহ, আসালত ফকির, ব্যাপারীপাড়ার আব্বাস উদ্দীন (রহঃ), গণি মস্তান, বজলু ফকির, গণিতবিদ কে.পি. বসু, কবি গোলাম মোস্তফার জন্মস্থান ঝিনাইদহ।
বিপ্লবী বাঘা যতীন, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলামের বীরত্বগাঁথা এবং ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের জেলা ঝিনাইদহ। গাজী-কালু-চম্পাবতীর উপাখ্যানখ্যাত হাওড়, বাওড়-নদী-কলা-পান, খেজুর গুড়, ধান-ফসলের প্রাচুর্যে ভরা খাদ্য ভান্ডার এই ঝিনাইদহ। প্রাচীন যুগের বিভিন্ন শাসনামলে ঝিনাইদহে স্থায়ী জনবসতি ও সু-সংগঠিত সমাজ ব্যবস্থার ইংগিত পাওয়া যায়। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে ঝিনাইদহ বঙ্গঁ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
ষষ্ট শতকে গুপ্ত রাজ্যের অধীন এবং ঐ শতকের মধ্যভাগে বঙ্গঁগুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হলে বাংলা বঙ্গঁ বা সমতট এবং গৌড় এই দুটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঝিনাইদহ অঞ্চলটি বঙ্গঁতথা সমতট রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ৭ম শতকে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং শশাঙ্কের মৃত্যুর পর সম্রাট হর্ষবর্ধনের অধীনে শাসিত হয়। ৭২৫-৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে কনৌজর রাজা যশোবর্ধন গৌড় ও বঙ্গঁ রাজ্য অধিকার করে নিলে ঝিনাইদহসহ সমগ্র বাংলা তার অধীনে চলে যায়। ৭৮১-৮২১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ঝিনাইদহ পাল রাজবংশের অন্তর্গত ছিল। পাল বংশের পতনের পর ১০৮০-১১৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্মণরা ঝিনাইদহ অঞ্চল শাসন করেন। ১১৫০ সালে বর্মণ রাজবংশ সেন রাজবংশের কাছে পরাজিত হলে ঝিনাইদহ সেন রাজ বংশের কর্তৃত্বে চলে যায়।
মুলত সেই সময় এই অঞ্চলে বিভিন্ন সূফি, পীর আওলিয়াদের আবির্ভাব ঘটে। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজি বঙ্গঁ বিজয়ের পর ১২৬৮ থেকে ১২৮১ পর্যন্ত ঝিনাইদহ মুসলিম রাজ্য তথা দিল্লী সালতানাতের অধীনে লক্ষনাবতীর অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৩৪২ সালে সুলতান শাসুদ্দিন ইলয়াস শাহ্ লক্ষনাবতীকে স্বাধীন সালতানাত ঘোষণা করে বাংলাকে একটি প্রশাসনিক কাঠামোতে আনেন। তাঁর আমলে মুসলিম শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়। সেসময় ঝিনাইদহ তার শাসনাধীনে ছিল। মুসলিম শাসনের হুসাইন শাহী আমলেও ঝিনাইদহের প্রশাসানিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। হুসেইন শাহী বংশের বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সুলতান গিয়াস উদ্দীন মহাম্মদ শাহ্ (১৫৩২-১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) দিল্লীর পাঠান সুলতান শের শাহের নিকট পরাজিত হলে বাংলা দিল্লীর শাসনাধীনে চলে যায়।
১৫৩৯-১৫৫৩ পর্যন্ত ঝিনাইদহ পাঠান সুলতানদের দ্বারা শাসিত হয়। এরপর ১৫৭৬ সালে দাউদ করোনারীর আমলে বাংলায় মোঘল শাসনের সূচনা হয়। এর প্রায় ৩৬ বছর পর ঝিনাইদহ মোঘল সা¤্রাজ্যের অধীনে আসে। সম্রাট আকবরের আমলে বারো ভূইয়াদের যশোরের এক রাজা ভূমি রাজস্ব আদায়সহ ঝিনাইদহে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকেন। এসময় রাজা প্রতাপাদিত্য মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ১৬১২ সালে মোঘল সেনাপতি তাকে পরাজিত করেন। এইসময় মোঘল আমলে ঝিনাইদহে ভূমি রাজস্ব স্তর ও ফৌজদারীসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সম্রাট শাহজাহানের আমলে যশোরে একটি পৃথক ফৌজদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ঝিনাইদহ ঐ ফৌজদারীর অন্তর্ভুক্ত হয়।
মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রাপ্ত সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দের পর সীতারাম রায় নামক একজন ভূ-স্বামীর আবির্ভাব ঘটে এবং ঝিনাইদহের শাসনভার তার হাতে চলে যায়। সীতারামের পতনের পর ১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দে যশোর ফৌজদারী চাচড়া, নলডাঙ্গা ও মহম্মদ শাহী এই ৩টি জমিদারির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ঝিনাইদহ নলডাঙ্গা ও মহম্মদ শাহী জমিদারীর আওতায় ছিল।
এ দু’জমিদারীর প্রশাসনিক কাঠামোর চিহ্ন ঝিনাইদহে আজো রয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২৩জুন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর বেতনভূক্ত সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ এর কাছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজয় বরণের ফলে বাংলা ও ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। ১৮৮১ সালে ঝিনাইদহ ইংরেজ শাসনের আওতায় আসে। ওই সময় ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী যশোরের মুরলীতে একটি অফিস বা কোর্ট স্থাপন করেন। বৃহত্তর যশোর, খুলনা, ফরিদপুর জেলাকে ওই কোর্টের অধীনে আনা হয়। এই কোর্টের ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হন ইংরেজ টিলম্যান হেংকেল। ইংরেজরা ঝিনাইদহের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষীদের ওপর চাপিয়ে দেয় নীল চাষ। ঝিনাইদহের খালিশপুর, বিজুলিয়া, হরিণাকুন্ডু, বাঘাডাঙ্গা, সাধুহাটিসহ বিভিন্ন স্থানে নীল কুটি স্থাপন করা হয়। নির্যাতিত চাষীদের নীল বিদ্রোহের ফলে ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন হয় ও নীল চাষ বন্ধ হয়।
নীল বিদ্রোহে ঝিনাইদহের কৃষকরা বাঁশ কেটে সুচলো করে লোহার ফালা লাগিয়ে চেঙ্গা জোরে ছুড়ে সাহেবদের ঘায়েল করতো। এছাড়াও ঝিনাইদহের রয়েছে বীরত্বগাথা ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল সদর উপজেলার বিষয়খালিত। প্রায় ৩ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধের পর ব্যর্থ হয়ে পাকিস্থানী সেনাদল পিছু হটে যায়। সারা জেলায় মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শেষে ৩ ডিসেম্বর মহেশপুর, ৪ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর, ৫ ডিসেম্বর কালিগঞ্জ ও ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ শহরসহ সমগ্র জেলা স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে সারা জেলায় ১৭৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন। জেলার শৈলকুপা থানা একসময় ফরিদপুর জেলার মধ্যে এবং মহেশপুর বনগাঁ মহাকুমার মধ্যে ছিল।
১৯৪৭ সালে মহেশপুর বাদে বনগাঁ মহাকুমা ভারতের অংশ হয়ে যায়। মহেশপুরকে সে সময় অবিভক্ত যশোর জেলার খাদ্য ভান্ডার বলা হতো। সেখানে গড়ে ওঠে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম দত্তনগর কৃষি ফার্ম। এ ভাবেই সারা বিশ্বে ঝিনাইদহের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে।