এখনও শিউরে ওঠেন গণকবর থেকে বেঁচে আসা শৈলকুপার বশির মাস্টার

প্রকাশিত: ৭:০৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩১, ২০১৮

এখনও শিউরে ওঠেন গণকবর থেকে বেঁচে আসা শৈলকুপার বশির মাস্টার
  • বিপ্লব কুমার পিন্টু, ঝিনাইদহ

৭১’র ভয়াল স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে গণকবর থেকে বেঁচে আসা বশির উদ্দিন আহমেদ মাস্টারকে। ৪৬ বছর আগে সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে হলে এখনও শিউরে ওঠেন অবসরপ্রাপ্ত এই স্কুল শিক্ষক।

বশির উদ্দিন জানান, বঙ্গবন্ধুর ডাকে ’৭১- এ মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি তখন কালীগঞ্জের মল্লিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনারা নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর আক্রমণ শুরু করায় তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেন।

তিনি জানান, শৈলকুপা ব্রিজের পাতা ফাঁদে পাক সেনরা পড়লে, ৩০ মার্চ রাত থেকে জনতার সঙ্গে তাদের নিধনে অংশ নেন। এরপর সিদ্দান্ত নেন ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। ১৬ এপ্রিল বাই সাইকেরে চেপে রওনা দেন। তবে তিনি জানতেন না, পাকিস্তানি সেনারা ঝিনাইদহ শহর দখল করে নিয়েছে। ক্যাসেল ব্রিজ পার হলে পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। নিয়ে যাওয়া হয় নবগঙ্গা নদীর তীরের পুরনো এসডিও অফিসের ভেতর। সেখানে আগে থেকেয় ৭ জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। অন্য একটি রুমে মজুত রাখা হয়েছে লুট করা সোনার গহনা ও দামি মালামাল। এরপর তাদের আলিয়া মাদরাসার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সরকারি হাইস্কুল, পিটিআই ও আশপাশের এলাকাজুড়ে মিলিটারি ভরে গেছে। সামরিক যানবাহনে বিরাট লাইন।

তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল দফায় দফায়। পরে সড়ক ও জনপদ বিভাগের পাশে একটি ফাঁকা জায়গায় বসানো হয়। কয়েক জন জোয়ান গাইতি দিয়ে বড় গর্ত খোঁড়ে। এরপর তাদেরকে প্রথমে বসতে পরে শুয়ে পড়তে বলা হয়। তিনি ভেবে ছিলেন রোদের ভিতর শোয়াইয়ে রেখে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে।

কিন্তু একজন অফিসার ৮ জনকেই চোখ বন্ধ করতে হুকুম দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেয় গুলি করতে শুরু করে পাকসেনারা। প্রথমে একটি গুলি তার পেট ভেদ করে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয় গুলি বুকে লেগে বাঁ হাতের কনুই ভেদ করে বের হয়ে যায়। হানাদাররা মৃত ভেবে মাঠে ফেলে রাখে। এরপর চুল ধরে টেনে গর্তে ফেলে স্তুপ করে মাটি চাপা দেয়া হয়। বশির উদ্দিন জানান, তখনও তার জ্ঞান আছে। কোনভাবে ডান হাত দিয়ে আস্তে করে কবরের উপরের কাপড় ও মাটি সরিয়ে বের হয়ে আসেন।

কিছুক্ষণ পর তার বাম পাশে একজন নড়ে ওঠেন। বেচে আছেন কিনা জানতে চাইলে সে হু বলে জবাব দেন। ভয়ে কথা বলছে না। একজন সেনা বুঝতে পারেন দুজন বেচে আছে। সে তখন তার অফিসারকে জানায়। কয়েকজন তাদেরকে দেখতে আসে। বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে।

বশির মাষ্টার জানান, তখন তার সারা শরীর রক্তে ভিজে গেছে। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। সন্ধ্যা ঘানয়ে আসছে। পাক সেনাদের সঙ্গে কয়েকজন নিরস্ত্র বাঙালিও ছিল। তার মধ্যে একজন পাশের টিউবয়েল থেকে পানি নিতে আসে। তার কাছে এক মগ পানি চান।

কিন্তু কোন কথা না বলে সে চলে যায়। পরে লুকিয়ে এক মগ পানি খেতে দেয়। একটু সুস্থ বোধ করার পর অন্ধকারে ভেতর কোন ভাবে কলাবাগানে ঢুকে কলাপাতার ডগা দিয়ে বাহাত গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে নেন। আবার পানি পিপাসায় বুক ফেটে যেতে থাকে। পাশের একটি পুকুরে নেমে পানি পান করেন। রক্তক্ষরণে শরীর নিথর হয়ে যায়। সিড়িঁর ওপরে পড়ে থাকেন। ভোরে এক লোক ঐ পুকুরে আসে। তার কাছে সাহায্য চান। কিন্তু লোকটি তাকে তুলতে পারে না। তালের রসের সঙ্গে মিষ্টি আলু মিশিয়ে খেতে দেয়। এতে শরীরে একটু শক্তি পান। তারপর ওই লোক তার ছোট ভাইসহ তাকে কাঁধে করে নবগঙ্গা নদী পার করে বাসুদেবপুর নিয়ে আসে। পরে একটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে বাড়ির উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। রয়েড়া ঘাট দিয়ে কুমার নদ পার হয়ে দামুকদিয়া স্কুলে পৌঁছান।

ইতিমধ্যে খবর পেয়ে বাড়ির লোকজন সেখানে পৌঁছে যান। কাদা মাটিতে ক্ষতস্থানে পচন ধরে, দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। সে সময় বাড়িতে ছিলেন কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ সিরাজুর ইসলাম। তিনি তার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ভাঙ্গাচোরা হাড় বের করে ব্যান্ডেজ করে দেন। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী মন্টু ও তার বড় ভাই শওকত আলী চেয়ারম্যান। বাড়ি ফিরে স্থানীয় ডাক্তারদের চিকিৎসায় দীর্ঘদিন পর সুস্থ হয়ে ওঠেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ