ঢাকা ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৪শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
প্রকাশিত: ৭:১৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের কৃষক নেতা মরহুম ওমর আলীর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক বন্ধুর অনুরোধে তার গরীব বেকার ভাতিজার সাথে ১৯৯০ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে মেয়ে মর্জিনাকে বিয়ে দেয়। মাঠে স্বামীর জমি ছিল না। শুধুমাত্র ভিটাবাড়ীতে একটি কুড়েঘর ছিল। অভাবী সংসারে তার স্বামী কাজ-কর্ম করতো না। অল্প বয়সে গ্রামের ঘোমটা পরা বধু হিসেবে এই অভাবী সংসারের ঘানি টানতে হতো তার। সে লোক চক্ষুর আড়ালে প্রায়ই কান্নাকাটি করত।
জানা যায়, না জেনে না বুঝে, বন্ধুর কথা মত তার ভাতিজার সাথে বিয়ে দিয়ে তার বাবার মনের অবস্থাও ভাল ছিল না। সারাক্ষণ মর্জিনাকে নিয়ে প্রায়ই চিন্তা ও কান্নাকাটি করত তার বাবা। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভাল ছিল না। মেয়ের অভাবী সংসারে সবসময় খোজ খবর নিতেন। মাঝে মধ্যে চাল, ডাল, তেল, পিয়াজ, রসুন, মাছ তরকারি ইত্যাদি পাঠিয়ে দিতেন। বাড়ীতে দেশী-বিদেশী হাঁস-মুরগী ও বাবার দেওয়া গরু-ছাগল পালন করত মর্জিনা।
তাছাড়া, বাড়ীর আশেপাশের অন্যের জমি বর্গা নিয়ে নিজে হাতেই বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করত। অল্প উপার্জনেই স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সহ মোট চার জনের সংসার অতি কষ্টে দিনাতিপাত করত। সে নিজে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারত না। এক কাপড়ে গোসল করে সেই কাপড় শুকিয়ে পরত সে। এই অভাবের মধ্যে ৬ বছরের ২টি ছেলে ও ১ মেয়ে জন্ম গ্রহন করে।
বাড়তে থাকে খরচ ও অভাব-অনটন। এতে বেকার অকর্মা স্বামীর সাথে গোলযোগ-অশান্তি যেন নিত্য দিনের সঙ্গী হয় তার। স্বামী প্রায়ই তার নানাভাবে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো। সন্তানদের দু’বেলা দু’মুঠো পেট ভরে খেতে দিতে পারত না। বেশীর ভাগ দিন নিজে না খেয়ে স্বামী সন্তানদের খাওয়াতো। পারত না দিতে তাদের স্কুলের বই-খাতা, কলম, পরনের পোশাক। । এমন সময় গেছে ১/২ দিন না খেয়ে অনাহারে কাটিয়েছে মর্জিনা । কাউকে কিছু বুঝতে দিইনি। বেশী কষ্ট হলে সন্তানদের নিয়ে কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ীতে চলে যেত।
মর্জিনা বেগম জানান, অভাবের তাড়নায় স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে আসে বাবার সংসারে। একসময় আত্মহত্যার পথও বেছে নেং সে। পরে সে সুস্থ্য হয়ে তার কলিজার টুকরাদের মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে সে পথ পরিহার করে। এক সময় তার বাবাও স্ট্রোক কওে মারা যান। শুরু হয় ভাই-ভাবীর সংসারে আরেক কঠিন যুদ্ধ।
এরপর, ঢাকার গাজীপুরের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে বীজ ও ফসল সংরক্ষণ এবং আলুর চিপস্ তৈরীর উপর ৩ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। ২০০১ সালে আমেরিকার কৃষি বিজ্ঞানীদের দোভাষীর মাধ্যমে কালীগঞ্জের মহেশ্বরচাঁদা গ্রামে কেঁচো সার উৎপাদনের উপর ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। প্রথমে নিজের ১টি গরু ও মাঠে পড়ে থাকা গোবর সংগ্রহ করে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন ও গবেষণা শুরু করে। প্রাণী সম্পদ কালীগঞ্জ অফিসের সহযোগীতায় নিজ ও আশপাশের গ্রামে হাঁস-মুরগীর রোগ প্রতিশেধক টিকা দেওয়ার কাজ করে। এগুলোতে যে পারিশ্রমিক পাই তা দিয়ে সংসারের অভাব কিছুটা লাঘব হতে থাকে।
দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহন করে ১টি মেশিন কিনে সেলাইয়ের কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে এলাকার বেকার ও দরিদ্র মহিলাদের বিনামূল্যে দর্জির কাজের প্রশিক্ষন দেয়। এতে অনেকেই একাজ করে সংসার চালাচ্ছে। ২ বছরে ৬টি জেলায় ভার্মি কম্পোস্ট ট্রেইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি (২০১৬-২০১৭) সমন্বিত খাদ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তা প্রকল্পের কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদনের ট্রেইনার হিসেবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থায়নে ও নিজ উদ্যোগে রংপুর, বগুড়া, ঠাকুরগাও, পঞ্চগড়, ময়মানসিংহ, শরিয়তপুর, হবিগঞ্জ, ফেনী, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, বরগুনা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলা গুলিতে প্রায় ২ হাজার কৃষাণ-কৃষাণীদের কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মাঝে বিনামূল্যে বিদেশী মা-কেঁচো ও মাটির চাড়ি বিতরণ করে। এর প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে প্রায় সকল দায়িত্ব মর্জিনা বেগম পালন করে। উক্ত চাষিরা প্রতি মাসে এখন শত শত টন উন্নতমানের কেঁচো সার উৎপাদন করছে এবং জমিতে ব্যবহার করে টন টন বিষমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য শস্য উৎপাদন করছে। এখন তারা প্রায় সবাই সাবলম্বী।
এই মহতি উদ্যোগ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনের একাধিকবার খবর প্রকাশিত হলে কৃষি বিভাগের নির্বাচনে ২০১৪ ও ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মর্জিনা বেগমকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারে সম্মানিত করেন।
তিনি আরও জানান, ২০১৬ সালে রাজশাহীতে এক কৃষক সমাবেশে তার বক্তব্য শুনে উপস্থিত প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর জনাব ড. আতিউর রহমান কেঁচো উৎপাদনের জন্য প্রান্তিক চাষীদের অল্প সুদে সহজ শর্তে বিনা মডগেজে গরু ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ঋণ ও আর্থিক সেবাভূক্তি বিভাগ থেকে ঋণ সুবিধা পাশ করে। যা মর্জিনা বেগম নিজে জামিনদার হয়ে ঝিনাইদহ ও যশোর জেলার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫০ জন গরীব কৃষাণ-কৃষাণীদের মধ্যে এ ঋণ আনুষ্ঠানিক ভাবে বিতরণ করতে সহায়তা করে। যা এখনও চলমান আছে।
তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে তিনি জানান, অর্গানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন ও প্যাকেজিং এর উপর সরকার আমাকে ২০১৩ সালে ভিয়েতনামে উন্নত প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছিলেন। কৃষিতে নারীর অবদানে প্রকৌশলী (এলজিইডি) অধিদপ্তর ২০১২ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচার ২০১৫ সালে সম্মাননা পুরস্কারও পেয়েছে। ষ্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫০ হাজার টাকা সহ বিশেষ সম্মাননা পুরস্কারে সম্মানিত করে। তাছাড়া ২০১৭ জয়ীতা অন্বেষণে ঝিনাইদহ জেলা পুরস্কার পেয়েছে।
আরেক সফল ভার্মি কম্পোষ্ট চাষী হেলাল উদ্দিন জানান, ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচেসার) উৎপাদনের পাশাপাশি গরুর খামারে গরু ও পুকুরে মাছ ও পুকুর পাড়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে সবজির চাষ শুরু করে। মর্জিনার ৩টি ফার্মে ৫ জন শ্রমিক স্থায়ী ও বিশেষ প্রয়োজনে ১০/১৫ জন শ্রমিক অস্থায়ী ভাবে কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। তার সফলতায় উৎসাহিত হয়ে এবং তার সর্বাত্বক সহযোগীতা ও পরামর্শে শিক্ষিত/আধাশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী ও গৃহবধুরা একাজে সম্পৃক্ত হয়ে অনেকেই সাবলম্বী হয়েছে।
জীবন সংগ্রামে সফল হয়ে বর্তমানে তার ২টি ছেলে ও ১টি মেয়েকে শিক্ষিত করেছে। বড় ছেলে চাকরী করছে। মেয়ে বর্তমানে বিএ (স্নাতক) শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে এবং ছোট ছেলে বর্তমানে ঝিনাইদহ কৃষি ইনষ্টিটিউটে কৃষি ডিপ্লোমা পড়ছে।
তিনি বলেন মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আমি এখন সাবলম্বী। প্রয়োজনীয় খরচ চালাতে পারি। ছেলে মেয়ে, আত্মীয় স্বজন নিয়ে সুখে শান্তিতে আছি। বর্তমানে সমাজে আমি একজন সম্মানী নারী।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ডিডি জি এম আব্দুর রহমান জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে এখন “নারী উদ্যোক্তা মডেল” মর্জিনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, উন্নয়ন মেলা ২০১৮ উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তার সাথে কথা বলেছেন।
সম্পাদক – মাহমুদ হাসান টিপু
নির্বাহী সম্পাদক – পিন্টু লাল দত্ত
বার্তা সম্পাদক – সোহাগ আলী
www.jhenaidahsongbad.com
jhenaidahsongbad@gmail.com
প্রকাশক- জাহিদুল ইসলাম বাবু মিয়া
ব্যবস্থাপনা পরিচালক – মোঃ মজিবুর রহমান সরকার
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়ক,ঝিনাইদহ
০১৭১১২৬০৩৯৩ / ০১৭১১৪৫২০৫১
Design and developed by zahidit.com