আওয়ামী লীগে সক্রিয় ৩ গ্রুপ বিএনপির ভরসা জামায়াত!

প্রকাশিত: ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৬, ২০১৭

আওয়ামী লীগে সক্রিয় ৩ গ্রুপ বিএনপির ভরসা জামায়াত!

কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলার দুটি পৌরসভা এবং ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ-৩ আসন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিন্ন ধরনের সংকটে পড়তে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগে ৩টি গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। আর বিএনপির জামায়াতনির্ভরতা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই! প্রধান এ দল দুটির অভ্যন্তরের কোন্দল প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীর হাজার হাজার নেতাকর্মী-সমর্থক রয়েছেন এ আসনে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটি চারদলীয় জোটে থাকার পরও বিএনপিকে ছাড় দেয়নি। এককভাবে ওই নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত। ওই নির্বাচনে (২০০৮ সাল) আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করলেও বিএনপির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন জামায়াত প্রার্থী।

এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সফিকুল আজম খান চঞ্চল বিজয়ী হন ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়ে। জামায়াতে ইসলামীর মতিয়ার রহমান ৮১ হাজার ৭৩৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় ও বিএনপির সহিদুল ইসলাম মাস্টার ৫৯ হাজার ১৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান দখল করেন।

এ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত মিলিয়ে মোট প্রাপ্ত ভোট ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৪, যা আওয়ামী লীগের চেয়ে ২১ হাজার ৩৯৩টি বেশি ছিল। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য আগামী নির্বাচনে বড় ভরসা জামায়াতে ইসলামী।

জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জামায়াত-শিবির সমর্থকরা স্থানীয় ভোট কেন্দ্রগুলোয় ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এরপরও মহেশপুর ও কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদের দুইজন চেয়ারম্যানই জামায়াত নেতা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত কী হবে এবং স্থানীয়ভাবে জামায়াত তা মানবে কিনা, তার ওপর বিএনপি প্রার্থীর ভাগ্য নির্ভর করছে। তবে জামায়াতের ওপর ভরসা করা ছাড়া বিএনপির নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব নয় বলেও ধারণা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।

বর্তমানে কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চোখে পড়ার মতো। উভয় দলে অন্তত ৩টি গ্রুপ সক্রিয়। গ্রুপগুলোর মধ্যে বিরোধ আরও বাড়ছে।

আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক এমপি সফিকুল আজম খান চঞ্চল, অপর গ্রুপে বর্তমান এমপি নবী নেওয়াজ এবং দুই মাস ধরে নতুন গ্রুপ চালাচ্ছেন বরিশাল বাকেরগঞ্জ সংরক্ষিত মহিলা আসনের (৩১৬) সাবেক এমপি পারভীন তালুকদার মায়া। এ তিনজনই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ময়জদ্দীন হামিদ বলেন, ‘মায়া তালুকদার এরই মধ্যে জনসংযোগ শুরু করেছেন।’

আগামী সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তিনি নিজেও জনসংযোগ করছেন বলে দাবি করেন ময়জদ্দীন হামিদ। তিনি দলের হ-য-ব-র-ল অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘২০০৪ সালের ৫ অক্টোবর মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে। ওই সম্মেলনে সভাপতি হন সাজ্জাতুস জুম্মা ও সাধারণ সম্পাদক হই আমি।

বিগত ১৩ বছরেও জেলা থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়নি। এতে করে স্থানীয়ভাবে দলের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে।’ এ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের নবী নেওয়াজ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এমপি হন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাকরিবাণিজ্য, প্রতারণা, টিআর, কাবিটা, কাবিখা, জিআর প্রকল্পের চাল, গম টাকা লুটের অভিযোগ করেন ময়জদ্দীন হামিদ।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান এমপির প্রকৃত বাড়ি চৌগাছা উপজেলার কাদবিলা গ্রামে। নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ২০০৮ সালের দিকে মহেশপুর পৌরসভার গোডাউন পাড়ায় কয়েক শতক জমি কেনেন তিনি। সেখানে টিনশেডের একটি বাড়ি বানান। এখন সেটি ৩ তলা ভবনে রূপান্তর হয়েছে।’ নবী নেওয়াজ পুলিশে জনবল নিয়োগের জন্য নিজে ট্রেনিং সেন্টার খুলে ১৯ জন যুবকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলেও অভিযোগ করেন ময়জদ্দীন হামিদ।

বর্তমান এমপি নবী নেওয়াজ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন।

তিনি বলেন, সাবেক দলীয় এমপি চঞ্চলের বিগত দিনের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, টিআর-কাবিখা আমি বুঝি না। দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে থাকা তালিকা মোতাবেক তা বিতরণ করা হয়।

এর জন্য পিআইও এবং ইউএনও অফিস দায়ী হবে। কোটচাঁদপুর উপজেলার কুশনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় যুবলীগ নেতা আবদুল হান্নানের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

মহেশপুর উপজেলার কাজীরবেড় ইউনিয়নের ঝিটকিপোতা গ্রামের মৌলভী মুহাম্মদ আলীর মেয়ে পারভীন তালুকদার মায়া। তার বিয়ে হয়েছে বাকেরগঞ্জ। ২০০১ সালে তিনি ঝিনাইদহ-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই বছর ৬ হাজার ৬২৮ ভোট পান তিনি।

তিনি জানান, ২০০৮ সালে বরিশালে সংরক্ষিত আসন থেকে তিনি মহিলা এমপি হন। মায়া বলেন, ২০১৮ সালে বাবার বাড়ি থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। দুই মাস ধরে জনসংযোগ করছি।

এখন পর্যন্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগে মায়ার কোনো পদ-পদবি না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে এলাকার হতদরিদ্র মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা তার সঙ্গে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী সফিকুল আজম খান চঞ্চল অবশ্য মায়া তালুকদারকে পাত্তা দিচ্ছেন না। চঞ্চল বলেন, মায়া স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কারণ তিনি বরিশাল থেকে স্থানীয় জিন্নানগর বাজারে একটি গার্মেন্ট কারখানার সুবাদে এলাকায় আসছেন। মায়া তালুকদারের দলের প্রাথমিক সদস্য হওয়ারও সুযোগ নেই।

চঞ্চল জানান, তিনি টানা দুই যুগ মহেশপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং হারানো পদ ফিরে পেতে প্রতিনিয়তই জনসংযোগ, দলীয় কর্মিসভা, সমাবেশ ও কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করছেন।

তিনি অভিযোগ করেন, ‘বর্তমান এমপি নবী নেওয়াজ দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত করছেন। দলের কিছু সুবিধাবাদী তাকে সহযোগিতা করছেন।’

এদিকে বিএনপির সাবেক এমপি সহিদুল ইসলাম মাস্টারের মৃত্যুর আগেই স্থানীয়ভাবে দলটির মধ্যে গ্রুপিং শুরু হয়। মারামারি-হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ে দলটির নেতাকর্মীরা। দিন দিন পরিস্থিতি আরও গুরুতর আকার ধারণ করছে।

আগামী নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কে হবেন- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সহ-সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান ও মহেশপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোমিনুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়।

কণ্ঠশিল্পী মনির খান বলেন, ছাত্রদল থেকে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দলের হাইকমান্ড থেকে মহেশপুর ও কোটচাঁদপুরে বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনগুলো গোছানোর জন্য তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন মনির খান।

তার ভাষায়- এরই মধ্যে দল গোছানোর কাজে তিনি ৯০ ভাগ সফল হয়েছেন। মহেশপুর উপজেলায় এ মুহূর্তে বিএনপির কোনো কমিটি নেই- এমনটি দাবি করে মনির খান আরও বলেন, সাবেক কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি দাউদ হোসেন দায়িত্ব পালন করছেন।

আগামী নির্বাচনে দলের কাছে মনোনয়ন প্রার্থনা করব। মহেশপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোমিনুর রহমান বলেন, সরকারি দলের নানা নির্যাতন সত্ত্বেও তৃণমূলের নির্যাতিত কর্মী-সমর্থকদের পাশে থেকেছি।

আগামী নির্বাচনে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। মহেশপুর উপজেলা কমিটি নিয়ে মনির খানের মন্তব্য নাকচ করে দেন মোমিন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমি।

বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য সাবেক এমপি মরহুম সহিদুল ইসলাম মাস্টারের ছেলে মেহেদী হাসান রনিও জনসংযোগ করছেন। দলীয় সূত্র মতে, এ তিনজনকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে দলটির মাঝে গ্রুপিং শুরু হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই আরও একটি গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।

সেটি হল ছাত্রদলের সাবেক নেতা বর্তমান কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সহ-সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুলের গ্রুপ। এ আসনে ২০১৩ সালের পর জামায়াত কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানে দলটির এ হাল হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে আগামী নির্বাচনে দলটির ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত মাঠে না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা গোটা জনপদ অনেকটা এককভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তবে আরও কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম প্রচার করা হচ্ছে। কেউ কেউ ছবি দিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন টানিয়েছেন। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী, কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শরিফুননেছা মিকি অন্যতম।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ