ঢাকা ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:৩৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০২০
নয়ন খন্দকার, বিশেষ প্রতিনিধি॥
ধান উৎপাদন করে কৃষকরা ন্যায্য মূল পাচ্ছেন না। ফলে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ৩শ জন চাষী বিকল্প পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদ শুরু করেছেন। তারা স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় “পানি সাশ্রয়ী কার্যকরী কৃষি অনুশীলন প্রকল্প” এর আওতায় ধান রোপন করা জমির এক কোনায় মিনি পুকুর খনন করছেন। সেই পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সেখানে করছেন মাছ চাষ। পাশাপাশি পুকুরের পানি সেচ হিসেবে ব্যবহার করছেন। এছাড়া পুকুরের চারি পাশে রোপন করছেন লাউ, বেগুন, পেঁপে, কচু, কলা, সীম, টমেটোসহ নানা প্রজাতির শাকসবজী। পুকুরের মাছ ও শাক সবজি বিক্রি করে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি জমিতে উৎপাদন হচ্ছে ধান। ধানের লোকসান পুষিয়ে উঠতে কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ও সুন্দরপুর-দুর্গাপুর ২টি ইউনিয়নের ২০ টি গ্রামের ৩শ জন চাষী বিকল্প এ পদ্ধতিতে চলতি বোরো মৌসুমে চাষাবাদ শুরু করেছেন।
সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক চান্দু বিশ্বাস জানান, ৪৬ শতকের এক বিঘা জমিতে চাষ দেওয়া বাবদ ৩৪শ টাকা, বীজ ও বীজতলা খরচ বাবদ ৮৫০, সেচ বাবদ ২০০০ হাজার টাকা, সার, কীটনাশক, আগাছ পরিস্কার, ধানকাটা, পরিবহন, ধানঝাড়া, শ্রমিক খরচ দিয়ে মোট খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। অবশ্য আমনে সেচ খরচ কম অর্থাৎ ১ হাজার টাকা লাগে। এক বিঘা জমিতে ধান পাওয়া যায় ৩৩ মণ। যার বাজার মূল্য ৭০০ টাকা করে পাওয়া যায় ২৩ হাজার ১০০ টাকা। উৎপাদন খবর বাদে ধান থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৩১০০ টাকা। অনেক সময় এর কমবেশি হয়ে থাকে। তাহলে ধান চাষ করে কৃষকের আর কয় টাকাই থাকে? এমনটি জানান তিনি।
তাই তিনি সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় পানি সাশ্রয়ী কার্যকরী কৃষি অনুশীলন প্রকল্পের আওতায় জমির এক কোনায় ১ শতকের একটি মিনি পুকুর খনন করেছেন। ওই পুকুরে তিনি বৃষ্টির পানি ধরে রেখেছিলেন। সেই পানি দিয়ে জমিতে সেচ দিয়েছেন। তাতে তার সেচ খরচ ২ হাজার টাকা বেঁচে গেছে। এছাড়া ওই পুকুরে তিনি মাছ চাষ করেছেন। পুকুরের চারিপাশে লাগিয়েছেন, কলা, বেগুন, পেঁপে,সীম, টমেটোসহ নানা প্রজাতির শাকসবজী। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে তিনি বাজারে ২ হাজার টাকার মত শাকসবজী ও ৩ হাজার টাকার মত মাছ বিক্রি করেছেন। এতে তার ৫ হাজার টাকা আয় হয়েছে। আবার সেচ খরচ বেঁচে গেছে ২ হাজার টাকা।
চান্দু বিশ্বাসের মত মহাদেবপুর গ্রামের নাছিম মন্ডল, বেজপাড়া গ্রামের সুফল ঘোষ, সুন্দরপুর গ্রামের বজলুর রহমান, আশাদুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তারসহ দুই ইউনিয়নের ৩শ কৃষক এ পদ্ধতিতে ধান চাষ করেছেন।
সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী তোফায়েল আহমেদ বলেন, তারা সুন্দরপুর-দুর্গাপুর ইউনিয়নের সুন্দরপুর, দুর্গাপুর, পূর্ব মহাদেবপুর, পশ্চিম মহাদেবপুর, আলাইপুর, কমলাপুর, ইছাপুর, পাইকপাড়া, ভাটপাড়া ও বেজপাড়া, এছাড়া নিয়ামতপুর ইউনিয়নের কুড়–লিয়া, বারোপাখিয়া, নরেন্দ্রপুর, নিয়ামতপুর, মহিষাডেরা, দাপনা, মোস্তবাপুর, মহেশ্বরচাঁন্দা, হরিগোবিন্দপুর ও আড়–য়াশলুয়া গ্রামে তাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছেন। তিনি আরো জানান, ২টি ইউনিয়নের ২০ টি গ্রামের ৩শ জন চাষীকে ভুগর্ভস্থ পানির উত্তোলন কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা, রোরোর পরিবর্তে রবি শস্য লাগাতে উদ্বুদ্ধ করা এবং ভেজা-শুকনা পদ্ধতিতে চাষাদের আগ্রহী করে গড়ে তোলার লক্ষে কাজ করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, কৃষকের ৩৩ শতকের বা ৪৬ শতকের এক বিঘা জমির এক কোণে এক দেড় শততে পুকুর কাটা হচ্ছে। এতে তার ফসলের খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না। বরং ওই পুকুরের পানি তিনি সেচ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছেন। এতে তার ২ হাজার টাকার সেচ খরচ কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাছ চাষ ও পুকুর পাড়ে শাক-সবজী উৎপাদন করে তা বিক্রি করে আর্থিকভাবে ওই কৃষক লাভবান হচ্ছেন।
মহাদেবপুর গ্রামের কৃষক নাসির মন্ডল জানান, সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন তাদের জমির এক কোনায় ১শতকের একটি পুকুর কেটে দিয়েছিল। আর তিনি নিজ উদ্যোগে আরো ২ শতক জমির উপর পুকুর কেটেছেন। তার মোট পুকুরের বর্তমান আয়তন তিন শতক। তিনি আরো জানান, এক দাগে ৯৯ শতক জমিতে ধান চাষ করেছেন। জমির পরিমান বেশি হওয়ায় তার সেচ বেশি লাগবে। যার কারনে তিনি ৩ শতক জমির উপর পুকুর খনন করেন। বর্ষার সময় ওই পুকুরে পানি সংরক্ষণ করে করে তিনি বর্তমানে জমিতে সেচ দিয়েছেন। এতে তার প্রায় ৫ হাজার টাকার সেচ খরচ বেঁচে গেছে। তিনি আরো জানান, সংস্থাটি তাদের বীজ সংরক্ষণের জন্য ড্রাম ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যার কারনে তাদের ধানের বীজও কিনতে হয়নি। এতে তারা উপকৃতই হচ্ছেন। এসব খবর কমে যাওয়ায় উৎপাদিত ধান থেকে তিনি লাভবান হবেন।
সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শিবুপদ বিশ্বাস জানান, জাপান ফান্ড ফর গ্লোবাল এনভাইরমেন্ট (জেএফজিই) আর্থিক সহযোগিতায় ২০১৯ সাল থেকে শেয়ার দ্য প্লানেট এ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় কালীগঞ্জের ২০ গ্রামে পানি সাশ্রয়ী কার্যকরী কৃষি অনুশীলন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়ে আসছে। তারা নিয়ামতপুর ও সুন্দরপুর-দুর্গাপুর ২টি ইউনিয়নের ১০০ জন চাষীকে ১০০ টি পুকুর কেটে দিয়েছেন। ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিটি পুকুর খনন করা হয়েছে। পুকুরে পানি কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, কিভাবে ক্ষেতে দিতে হবে, পুকুর পাড়ে কিভাবে সবজী উৎপাদন করতে হবে এসব বিষয়ে তাদের ওরিয়েন্টেশন দেয়া হয়েছে। এছাড়া বীজ সংরক্ষণের জন্য তাদের ড্রাম প্রদান ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কৃষকদের লাভজনক সফল উৎপাদনে রোরোর পরিবর্তে রবি শস্য চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জাহিদুল করিম বলেন, সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় যেভাবে পুকুর খনন করা হচ্ছে তাতে কৃষকরাই লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া ভুগর্ভস্থ পানির চাপও কম হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তারা সেচ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। পুকুরে মাছ চাষ ও পুকুর পাড়ে শাক-সবজি উৎপাদন করতে পারবেন। এটা একটি ভাল দিক। তবে ওই পানি দিয়ে শতভাগ সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন। শুস্ক মৌসুমে কিছুটা সেচ অন্য ভাবে দিতে হবে। কৃষি বিভাগও বিভিন্ন সভা সেমিনারে কৃষকদের এভাবে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করছেন বলেও তিনি জানান।
Design and developed by zahidit.com