ঢাকা ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১২:২৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
নয়ন খন্দকার, বিশেষ প্রতিনিধি॥
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের পিংকী খাতুন। সোমবার (১৪ অক্টোবর) ৫ম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১২ হাজার ৮৮০ ভোট পেয়ে তিনি বেসরকারিভাবে জয়লাভ করেন। তৃতীয় লিঙ্গের পিংকী খাতুন কোটচাঁদপুরের জনগণের উন্নয়ন ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সম্মান এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সকালে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন। পিংকী ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার দোড়া ইউনিয়নের সোয়াদি গ্রামের নওয়াব আলীর সন্তান।
সাক্ষাতকারে ৩৭ বছর বয়সের তৃতীয় লিঙ্গের পিংকী খাতুন বলেন, নির্বাচনে জয়লাভের পর ভাল লাগছে। কোটচাঁদপুরের জনগন আমার সাথে আছে। তারা আমাকে ভালবেসে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন। এজন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। জনগন আমাকে তাদের আপনজন মনে করেন, কাছের লোক মনে করে আমাকে বিজয়ী করেছেন। পরিবারের সদস্যদের অনুভুতির ব্যাপারে তিনি বলেন, তারা আমাকে নির্বাচনের কাজে সহযোগিতা করেছেন। ভোটে আমি বিজয়ী হলে তাদের মুখ উজ্জ্বল হবে ও এলাকার জনগনও উপকৃত হবেন।
সাক্ষাতকারে পিংকী আরো বলেন, তিনি সব সময় জনগনের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ৩ বছর যাবত উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহবায়ক ও দোড়া ইউনিয়নের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি সব সময় গরীব,দুখী ও অসহায় মানুষদের পাশে থেকে তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করছেন। কেউ অসুস্থ হলে তাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। গভীর রাতে কেউ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেই রাতেই তাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান। এ ধরনের অসংখ্য কাজের নজির রয়েছে পিংকী খাতুনের।
আপনি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন এখন জনগন ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য কি করতে চান? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি জনগনের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। অসহায় নারীদের পাশে থাকতে চাই। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে চাই। যুব সমাজের পাশে থেকে উন্নয়নের কাজ করতে চাই। সন্ত্রাসমুক্ত করতে চাই। আর যারা তৃতীয় লিঙ্গের আছেন, আমি চাই তারা সম্মান পাক। প্রতিটা এলাকার প্রতিটা স্থানের সম্মানের মর্যাদা বেছে নিক। তাদের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সাক্ষাতকারে নির্বাচনে তাকে কারা উদ্বুদ্ধ করেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তৃতীয় লিঙ্গের নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান পিংকী খাতুন জানান, গ্রামের সকল নারী-পুরুষ আমাকে ভোট করার জন্য উৎসাহ ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তারা আমার সাথে ছিলেন। তাদের অনুপ্রেরণায় আমি ভোটের মাঠে নেমেছিলাম।
তিনি আরো জানান, শপথ নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন।
পারিবারিক বিষয়ে তিনি বলেন, তারা মোট ৪ ভাই বোন। পিতা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা কুলসুম বেগম জীবিত আছেন। দ্ইু ভাই শেখ জালাল ও শেখ রতন কৃষি কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করেন। আর বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হবার পর সকলের সাথে শুভেচ্ছা ও কুশালাদি বিনিময় করে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
রাজনীতিসহ সামাজিক কাজে পদার্পনের ব্যাপারে তিনি বলেন, সকল আলোচনা-সমালোচনা ও ভেদাভেদ ভেঙ্গে রাজনীতিসহ সর্ব ক্ষেত্রে পদার্পন করার ব্যাপারে কোটচাঁপুর ও মহেশপুর ( ঝিনাইদহ-৩) আসনের সাবেক এমপি নবী নেওয়াজ এর অনুপ্রেরণা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
একটা মানুষ ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত বিভিন্নভাবে নিগৃহের শিকার হয়ে থাকে। আর আপনি তো তৃতীয় লিঙ্গের, সেদিক থেকে আপনি কখনো কি কোন নিগৃহের বা বাঁধা বিপত্তির শিকার হয়েছেন?
এমন প্রশ্নের জবাবে পিংকী খাতুন জানান, প্রথম দিকে অনেকেই বলেছেন ওতো তৃতীয় লিঙ্গের লোক, কেমন করে ভোট করবে, কে ভোট দিবে? যারা এসব বলেছেন, পরক্ষণে আমি তাদের কাছে গিয়ে সময় দিয়েছি। বলেছি আমি আপনাদের সন্তান। এমন সন্তান যদি আপনার ঘরে হতো তাহলে কি আপনি তাকে সন্তান হিসেবে থেকে অস্বীকার করতে পারতেন? আমি তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। তারা আমাকে ভালবেসেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন।
ভোটার ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কি জানতো আপনি যে তৃতীয় লিঙ্গের? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন এটা সবাই জানতো। সবাই আমাকে ভালবেসেই ভোট দিয়েছে।
শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কোটচাঁদপুর উপজেলার সাবদার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু পাস করতে পারিনি। এরপর আর পড়াশুনা করা হয়নি।
কোটচাঁদপুর উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক মীর মনিরুল আলম বলেন, তিন বছর আগে পিংকী যখন রাজনীতিতে আসে তখন অনেকেই তাকে মেনে মেনে নিতে চাননি। সে সময় অনেক মানুষ তাকে অনেক রকম কথাবার্তা বলেছেন। ভিন্ন লিঙ্গের হলেও সে সময়ের সাবেক এমপি নবী নেওয়াজ তাকে রাজনীতিসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছেন। ভোটের সময় আমি ও আমার দলের অনেক লোক তাকে সাহায্য করেছি। আমি ও বলুহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন তার নির্বাচনী সমন্বনায়ক ছিলাম। আমি মনে করি পিংকী খাতুন গরীব,দুখী অসহায় ও নির্যাতিত মানুষ পাশে থেকে তাদের উন্নয়নে এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাবেন।
কোটচাঁদপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার তাজুল ইসলাম বলেন, পিংকীর আচার আচরণে মানুষ মুদ্ধ হয়ে তাকে ভোট দিয়েছে। তার চলাফেরা কথা কথনে মানুষ মুগ্ধ। তিনি আরো বলেন, যে উপজেলা মহিলা যুবলীগের আহবায়ক সে একেবারে দুর্বল পজিশনের মানুষ না। তৃতীয় লিঙ্গ বলে কোন কথা নয়, সে যদি সকল কর্মকা-ে সুযোগ পায় তাহলে অবশ্যই সে তার কাজে অবদান রাখতে পারবে এবং মানুষের চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।
বলুহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন বলেন, তাকে উৎসাহিত করার পেছনে রয়েছেন আমাদের সাবেক এমপি সাহেব (নবী নেওয়াজ)। তিনিই তাকে মহিলা যুবলীগের আহবায়ক বানিয়েছিলেন। সে তৃতীয় লিঙ্গের হলেও তার আচার-আচরণ খুবই ভাল। সে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আদর্শকে জড়িয়েই চলাফেরা করে। আমি আশাবাদি সে জনগনের উন্নয়ণমূলক সেবা করতে সক্ষম হবে।
জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সালমা ইয়াসমনি বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে পড়া মানুষদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য পিংকি খাতুন ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন এবং তিনি জয়ীও হয়েছেন। আমি আশা করি, পিংকি খাতুন তৃতীয় লিঙ্গের হলেও সে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নে কাজ করবে।’
Design and developed by zahidit.com