ঢাকা ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৭, ২০১৮
ঝিনাইদহ সংবাদ ডেস্ক :
যেখানে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয় সেখানেই চলছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর সেই অভিযোগের তীর সয়ং প্রতিষ্ঠান প্রধানের দিকে। এমন চিত্র ঝিনাইদহ প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (পিটিআই) এর।
বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি, আইসিটি প্রশিক্ষনের জন্য আসা শিক্ষকদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে টাকা। প্রতিবাদ করলেই নাকে খত কিংবা সুপারের পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষক ও প্রশিক্ষকরা।
সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষা দানের গুনগতমান বৃদ্ধি করতে পঞ্চাশের দশকে শুরু হয় পিটিআই স্থাপনের কাজ। এরই ধারবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে ঝিনাইদহে স্থাপন করা হয় প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র(পিটিআই)।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পর্যায়ক্রমে ভালভাবেই এগোচ্ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। কিন্তু পরবর্তিতে ২০১৫ সাল থেকে দুর্ণীতির উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয় এটি। শিক্ষার্থী ভর্তি কিংবা প্রশিক্ষণ রত শিক্ষক কেউই মাফ পাচ্ছে না দুর্নীতির কবল থেকে। উল্টো অপমান-অপদস্ত হতে হচ্ছে।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ৪৪ ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে এর মধ্যে ডিপিএড, আইসিটি সহ মৌলিক প্রায় ২৫ ভাগ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় পিটিআইতে।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কিংবা অন্য কোন খাতে টাকা নেওয়া যাবে না। কিন্তু ঝিনাইদহে রশিদের সাহায্যে শিশু শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৭২০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা কখনও কখনও তারও বেশী নেওয়া হচ্ছে। অন্যথায় সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছে না বলে অভিযোগ করেন অভিভাবকরা।
এদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পিটিআইতে ১৮মাস ব্যাপী ডিপিএড প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এক বছর পিটিআইতে এবং ছয় মাস নিজ স্কুলে ক্লাস কার্যক্রম চালানোর পর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে চুড়ান্ত সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
এখানে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করিয়ে দেওয়া ও ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে দুই হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ এবং ছয় হাজার করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর সেটি করছেন সুপার আতিয়ার রহমান তার নিজ অনুগত কিছু শিক্ষক দিয়ে।
২০১৫ সালের শেষের দিকে এমন অনিয়মের বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষক প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। এরই ফলশ্রুতিতে লিখিত পরীক্ষা চলাকালে সঠিকভাবে হলে দায়িত্ব পালন করছিলেন তৎকালীন প্রশিক্ষক অরুন কুমার খা। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সুপারের ইন্ধনে কতিপয় ব্যক্তি দ্বারা শারীরিক ভাবে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। পরবর্তিতে নানা অপবাদ দিয়ে বদলি হতে বাধ্য করা হয়।
ওই বছরই পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয় দেখিয়ে সুপার আতিয়ার রহমান অধিকাংশ প্রশিক্ষনার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণে টাকা নেন বলে অনেকেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে থাকলে নানাভাবে সুপার অন্যান্য শিক্ষকদের দমাতে পারলেও দমাতে পারেনি শিক্ষক গৌরাঙ্গ বিশ্বাসকে। তিনি এর প্রতিবাদ করলে বাসায় ডেকে নিয়ে তাকে অপদস্ত করা হয়। মৌখিক পরীক্ষার সময় সুপারের পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হয় এমনকি উপস্থিত সকলের সামনে নাকে খত দিতে বাধ্য করানো হয়।
সেই শিক্ষক গৌরাঙ্গ বিশ্বাস জানান, আমি তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি এ জন্য আমাকে সকলের সামনে নাকে খত দিতে বাধ্য করিয়েছে সুপার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা মানুষ গড়ার কারিগর আর তাদেরই এভাবে অমানিত-অপদস্ত হতে হচ্ছে। এটা গোটা শিক্ষক জাতির জন্য লজ্জা জনক। এর কঠোর বিচার হওয়া উচিৎ। কিন্তু কেন, কোন অদৃশ্য শক্ষির বলে এরা ছাড়া পাচ্ছে। এটাকি জাতি দেখছে না নাকি সকলে ঘুমিয়ে আছে ??
শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তখনকার প্রশিক্ষক অরুন কুমার খা বলেন, সেসময় আমি ঝিনাইদহ পিটিআইতে কর্মরত ছিলাম। জানতে পেরেছিলাম পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। তাই পরীক্ষার হলে সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করে বের হয়ে আসলে কয়েকজন প্রশিক্ষণরত শিক্ষক ও বহিরাগত পিটিআই গেটে আমাকে লাঞ্চিত করে মারপিট করে। এটা অবশ্যই সুপারের ইন্ধনে হয়েছে। তার ইন্ধন ছাড়া প্রতিষ্ঠানের গেটে এমনটি করা সম্ভব নয়। তিনি অন্যায় করে নিজের দোষ ঢাকতেই আমার উপর ও গৌরাঙ্গের উপর চড়াও হন।
জেলার শহীদ মোশাররফ হোসেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিজানুর রহমান ও জিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শারমিন সুলতানা সোহানা বলেন, আমরা ২০১৭ সালে পিটিআই থেকে আইসিটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি ১২ দিনের। এসময় আমাদের সকলের কাছ থেকে জনপ্রতি প্রতিদিনের সিট ভাড়া বাবদ ৫০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সিট ভাড়া বা আবাসিক চার্জ বাবদ টাকা নেওয়ার কোন নিয়ম নেই।
জেলা শহরের হামদহ খন্দকার পাড়ার রেক্সোনা বেগম বলেন, আমার মেয়ে পিটিআই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। কিন্তু ভর্তির সময় সাররা বলে টাকা না দিলে মেয়েকে তারা ভর্তি করবে না। তাই বাধ্য হয়ে ৯শ’ টাকা দিয়ে মেয়েকে ভর্তি করিয়েছি।
ক্ষুব্ধ অন্যান্য অভিভাবকরা বলেন, সরকারী স্কুলে এমন অনিয়ম তো অবশ্যই বন্ধ হওয়া দরকার আর যারা এর সাথে জড়িত তাদের অবশ্যই শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে। কেননা অনেক দরিদ্র পরিবার আছে যারা দিন আনে দিন খায়। তাদের পক্ষেতো সন্তানের ভর্তির জন্য এতো টাকা দেওয়া সম্ভব না।
ঝিনাইদহ জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারন সম্পাদক এনএম শাহজালাল জানান, বিভিন্ন সময়-ই পিটিআই এর নানা অনিয়মের বিষয়ে শোনা যায়। শিক্ষাদান কিংবা প্রশিক্ষনার্থীদের কাছ থেকে আর্থিক লেনদেন হয়। আমরা আশা করবো সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা শিক্ষা মন্ত্রনালয় বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
অন্যদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ মো: আকতারুজ্জামান জানান, আমি যোগদানের পর থেকেই আজ অবধি সুপার আতিয়ার রহমান আইসিটি প্রশিক্ষন নেওয়া শিক্ষকদের তালিকা দেয়নি। লিখিত ভাবে জানানোর পরও সে দেয় না। এর ফলে জানতে পারছি না কারা আইসিটি প্রশিক্ষণ নিয়েছে আর তারা ঠিকভাবে ক্লাস নিচ্ছে কি না। আমাদের খুব সমস্যা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষা নীতি মালায় আছে আইসিটি প্রশিক্ষণের জন্য পিটিআই সুপার ডিপিইও এর মাধ্যমে শিক্ষক ডেপুটেশন চাইবেন। কিন্তু তিনি আদৌ তা করেন না। অবশ্যই তিনি শিক্ষা নীতিমালা লঙ্ঘন করে এটি করছেন। বিষয়টি লিখিত ভাবে অধিদপ্তরকেও জানানো হয়েছে।
তবে এসকল অভিযোগের বিষয়ে নিজের সাফাই গাইলেন পিটিআই সুপার আতিয়ার রহমান। বলেন, আমি ভর্তির জন্য কোন টাকা নিই না। শুধু সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ভর্তির সময় একবারে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রশিদের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হয়। আর প্রশিক্ষণ কিংবা অন্য কোন বিষয়ে আমি জড়িত না, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট।
ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ জানান, পিটিআই সুপার আতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, প্রশিক্ষনার্থীদের লাঞ্ছিত করা সহ নানা অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি অবশ্যই তদন্ত করবো এবং সত্যতা পেলে বিভাগীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মন্ত্রনালয় ও অধিদপ্তরকে জানাবো।
ঝিনাইদহ শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪৪৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে আর প্রশিক্ষণ রত শিক্ষক রয়েছেন ২৪০ জন। প্রতি বছরের জানুয়ারী থেকে জুন মাস পর্যন্ত কয়েকটি ব্যাচে (প্রতি ব্যাচে ২৫ জন শিক্ষক) স্কুল শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের জন্য আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সুপার আতিয়ার রহমান ২০১৫ সালে ঝিনাইদহ প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে যোগদান করেন, সেই সময় থেকেই শুরু নানা অনিয়ম।
Design and developed by zahidit.com