ঢাকা ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৭:৫৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭
ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ
দাসপাড়ায় বসতি ছিল ১০ পরিবার। দরিদ্র পরিবারগুলোর সদস্যদের মধ্যে ২ থেকে ৩ জন ছিলেন প্রতিবাদি। এই খবর শত্রুদের মাধ্যমে চলে যায় পাকিস্থানী বাহিনীর কাছে। ১৪ মে তারা হামলা চালায় দাসপাড়ায়। একসঙ্গে চারজনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্থানী হানাদাররা। পড়ে থাকা লাশগুলো তাদের দোসররা একটি গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেন। নিজের চোখে দেখা ওই দিনের সেই ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করলেন রাজন দাস।
দাসপাড়ার ভদু দাসের পুত্র রাজন দাস আরো বলেন, হত্যার পর মাটিচাপা দিয়ে তারা যখন চলে যায় তখন তিনি লুকিয়ে থাকা অবস্থা থেকে বাইরে বের হন। বাড়িতে এসে দেখতে পান তার বাবাসহ চারজনকে হত্যার পর এক গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি সব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দেখে পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যান তারা। আজো স্বজনদের এই করুণ মৃত্যু ভুলতে পারেনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের দাস সম্প্রদায়ের ওই মানুষগুলো।
সরেজমিনে দাসপাড়াতে গিয়ে দেখা যায়, যে গর্তে চারজনের লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল সেটি এখন ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে নেপিয়ার ঘাষের চাষ হচ্ছে। কলাগাছও রয়েছে বেশ কয়েকটি। জমির মুল মালিক হতদরিদ্র গোপাল দাস ফুলবাড়ি গ্রামের আব্দুল হক নামের এক ব্যক্তি কাছে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। যার কারণে গণকবরের কোনো চিহ্ন আজ আর নেই। তারা এই স্থানটি চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছেন।
ফুলবাড়ি গ্রামের রবিউল ইসলাম জানান, দাসপাড়াতে বর্তমানে ১৪ টি পরিবার বসবাস করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাস করতো ১০ পরিবার। এদের মধ্যে ভদু দাস, অন্ন দাস ও অঙ্গ দাস কিছুটা প্রতিবাদী ছিলেন। নানা বিষয়ে তারা প্রতিবাদ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাবে সহযোগিতা করতেন। এই খবর তাদের গ্রামের কয়েকজনের মাধ্যমে চলে যায় পাকবাহিনীর কাছে। যারা ওই বাহিনীর দোসর ছিলেন। পাকবাহিনীরা খবর পেয়ে ১৯৭১ সালের ১৪ মে সকালে দাস পাড়ায় হামলা চালায়। রবিউল ইসলাম আরো জানান, তিনি এ সময় দাসপাড়ার নিচে ফুলবাড়ি মাঠে ছাগল চরাতে যান। পাকিস্থানী বাহিনী তাকে ডেকে মুসলিম শুনে ছেড়ে দেন। তার সঙ্গে ওই মাঠে থাকা আব্দুল জব্বার ও সামছুদ্দিনকেও মুসলিম কিনা পরীক্ষা করে ছেড়ে দেন। তারা একে একে গুলি করে হত্যা করে ভাদু দাস, অন্ন দাস, অঙ্গ দাস ও কিরণ দাসকে। কিরণ দাস পরের ক্ষেতের কামলা ছিলেন, বাকিরা চাটাই তৈরীর কাজ করতেন। রবিউল ইসলাম জানান, চারজনকে হত্যার পর বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই গোটা ঘটনা পাকস্থানীদের দোসর তাদের গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি সহযোগিতা করেন।
ভদু দাসের পুত্র রাজন দাস জানান, সেদিনের ঘটনায় দাসেদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা তিনজন মাতবরসহ চারজনকে হারিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাড়িঘরের। গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। পরবর্তীতে অভাবের কারনে এই দাসেদেরই একজন গোপাল দাস তার জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এই বিক্রির কারনে হারিয়ে যেতে বসেছে দেশের জন্য জীবন দেওয়া চার শহীদের ঘুমিয়ে থাকা স্থানটিও। হারিয়ে যাচ্ছে শেষ স্মৃতিটুকুও। তিনি বলেন, এই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ব থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারতো, জানতে পারতো হানাদারদের হাতে এভাবে কত মাসুষকে জীবন দিতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে কোটচাঁদপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার তাজুল ইসলাম বলেন, এই স্থানটি আজো তাদের অজানা। তারা কোটচাঁদপুর উপজেলায় যেগুলো গনকবর রয়েছে সেগুলোর একটি তালিকা মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে এই স্থানটি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, দ্রুত খোজখবর নিয়ে এই স্থানটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Design and developed by zahidit.com