ঢাকা ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৭:২২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০
নয়ন খন্দকার, কালীগঞ্জ॥
চোখ মুখে অভাব অনাটনের ছায়া। হতদরিদ্র মানুষটি শেষ কবে নিজের গায়ের পোশাক কিনেছেন তাও বলতে পারেন না। জীবীকার অন্বেষনে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন হকারী। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যান্ডের বিভিন্ন বাসের মধ্যে কখনো তিলে খাজা, কখনো ঝুরি ভাজা, কখনো হাতপাখা, রোমাল, আবার কখনো কলা কিংবা অন্যান্য ফলমূল ফেরি করে বিক্রি করে থাকেন। প্রাইমারি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও অভাব অনাটনের কারনে আর পড়তে পারেননি। কিন্তু অনেক বই পুস্তক পড়ে নিজেকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত মিরাজুল হক।
নিজে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে না পারলেও অর্থ অভাবে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া মানুষগুলোকে বই পড়ার মাধ্যমে মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখান মিরাজুল হক। হকারী করে তিনি প্রায় আড়াই লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন ৪ শতাধিক বিভিন্ন প্রকারের বই। তিনি মনে করেন, পাঠাগার থাকলে এলাকার গৌরব উজ্জ্বল হয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য,সাংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে ও জানাতে ভুমিকা পালন করবে। এমন উপলদ্ধি থেকে তিনি নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার। কিছুদিন নিজ ব্যয়ে পাঠাগারটি চালানোর পর এখন অর্থ জায়গা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাঠাগারটি চালাতে পারছেন না। পাঠাগারের অভাবে চার শতাধিক বই বাড়িতেই বাক্সবন্ধী করে রেখেছেন। অনুযোগের সুরে তিনি বলেন, অনেক কষ্টের পরও বঙ্গবন্ধুর নামে স্থাপিত পাঠাগারটি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আলোর মুখ দেখছে না।। তিনি চান পাঠাগারটি আলোর মুখ দেখুক। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ জ্ঞান অন্বেষনে পাঠাগারে এসে মিলন মেলার বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক।
শুধু তাই নয় মৃতুর পর তিনি মরনোত্তর দেহ ও চক্ষু দান করতে চান। সেজন্য তিনি রোটারীও করে রেখেছেন। কোন মেডিক্যাল কলেজ তার দেহটি নিতে চাইলে তিনি দিতে আগ্রহী বলেও জানান। মৃত্যুর পর তার দেহটি যাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয় সেজন্য তিনি চিকিৎসাদের প্রতি আহবান জানান।
ফেরিওয়ালা মিরাজুর হক ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কলেজপাড়ার মৃত ইব্রাহিম মোল্ল্যার ছেলে। স্ত্রী জুলেখা বেগম, দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে তার পরিবার। দুই মেয়ে শারমিন সুলতানা মিনা ও পারভিন সুলতানা মুক্তার বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ও আলমগীর মোল্ল্যাা। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা সাবজেক্টে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর ছোট ছেলে আলমগীর মোল্ল্যাও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বিশ^ ধর্ম ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সাবজেক্টের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রিড়া চক্রের প্রিমিয়ার লীগের নিয়মিত ফুটবল খেলোয়াড়।
ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক বলেন, অভাব অনাটনের জন্য তিনি লেখাপড়া করতে পারেননি। কোন রকম প্রাইমারী শেষ করে ১৯৭৮ সাল থেকে কালীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে হকারী করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে মাসে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে সংসার চালানোসহ ছেলেদের লেখাপড়া শেখানো ও মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। লেখাপড়া শিখতে না পারার আক্ষেপ থেকেই তিনি ছোট বেলায় বিভিন্ন রকমের বই পড়তে থাকেন। আর সেখান থেকেই বই কেনার নেশায় পড়েন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিও রয়েছে তার অগাধ ভালবাসা। নিজেকে তিনি বই প্রেমিক ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে দাবি করেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি পুরো দমে বই কেনা শুরু করেন। রকমারি ডটকম ও সলেমানিয়া বুক ডিপো থেকে তিনি বই গুলি কিনেছেন। দুইশত টাকা থেকে শুরু করে ১২শ টাকা দামের বইও কিনেছেন তিনি। দেশ বিদেশের খ্যাতিনামা ইতিহাসবিদ লেখকসহ তার সংরক্ষণে বিভিন্ন লেখকদের ৪ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, ধর্ম, সাংস্কৃতিক, ভাষা আন্দোলন, কবিতা, উপন্যাসের বই রয়েছে।
তার ক্রয় করা দামি বইয়ের মধ্যে রয়েছে আমার কর্ম আমার জীবন, জনকের মুখ, মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুরা, মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর দলিল ও ইতিহাস, বাঙ্গালীর স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের জন্ম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকা-, মুক্তিযদ্ধের ১৬ জন সেক্টর কমান্ডার, স্বাধীনতা উত্তর ট্রাজেডি মুজিব থেকে জিয়া, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, ৭১ এর যুদ্ধ শিশু অবিদিত ইতিহাস, ত্রিশ লক্ষ শহীদ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা প্রভৃতি।
বই গুলি কেনার পর ২০১৫ সালের মার্চ মাসে শহরের কলাহাটা মোড়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠাও করেন। ঝিনাইদহ-৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজীম আনার সেই পাঠাগারটি উদ্বোধনও করেন। প্রথম কয়েকবছর নিজ অর্থে পাঠাগারটি চালালেও পরে অর্থ, জায়গা ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে পাঠাগারটি আর চালাতে পারেননি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি গরীব,অসহায় ফেরিওয়ালা বলে সমাজে অবহেলিত। আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ৪ শতাধিক বই কিনে বঙ্গবন্ধুর নামে পাঠাগারটি করলেও তা আজও আলোর মুখ দেখলো না। শহরের অনেক স্থানে খাস জমি রয়েছে। আমি চাই সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পাঠাগার করা হোক। এজন্য তিনি সরকারি দপ্তর ও রাজনীতিবিদদের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। পাঠাগারের জায়গার জন্য আবেদনও করেছেন। কিন্তু পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠায় কেউ এগিয়ে আসেননি। তিনি আরো জানান, বর্তমান ও আগমী প্রজন্মকে আমাদের ধর্ম, সাংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে ও জানাতে যে উদ্যোগ নিয়েছেন সে কাজটি করতে তাকে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তি তাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আর এ পর্যন্ত ৮ জন ব্যক্তি তাকে ৫৭০০ টাকা অনুদান দিয়েছেন। সেই অনুদানের টাকা তিনি জমা করে রেখেছেন।
তিনি আরো জানান, তার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস’র জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ছোট ছেলে আলমগীর মোল্ল্যা একই বিশ^বিদ্যালয়ের বিশ^ধর্ম ও সাংস্কৃতি সাবজেক্টে নিয়ে ২য় বর্ষে পড়াশুনা চালিয় যাচ্ছেন। বড় ছেলে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে পড়াশুনা করতো আর ছোট ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রিড়া চক্রের প্রিমিয়ার লীগের নিয়মিত ফুটবল খেলোয়াড়। তাদের টাকা দিয়েই তারা লেখাপড়া করছে। মাঝে মধ্যে তিনি কিছু টাকা দিতেন। আর দু’মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আনেক আগেই। হকারী করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকম সংসার চালান আর বই কেনেন। এখন তিনি পাঠাগারটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চান।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বাবু মন্টু গোপাল বলেন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজন। ছাত্র-ছাত্রীসহ কালীগঞ্জের গণ মানুষের জ্ঞানের ঠিকানা খুঁজে পেতে হলে পাঠাগারের কোন বিকল্প নেই। ফেরিওয়ালা মেরাজুল হক পাঠগারটি দাঁড় করাতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক জটিলতার কারনে এটা আলোর মুখ দেখছে না। তিনি আরো বলেন, মিরাজ যে কাজ করেছে তা সিঃসন্দেহে প্রসংসা পাওয়ার দাবিদার। কারন একটা মানুষ তার জীবনের ফেরি করা অর্থ দিয়ে যেসকল বই সংগ্রহ করেছে যা কালীগেঞ্জ কারো কাছে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক, ইতিহাসসহ সব ধরনের জ্ঞান অর্জন করার মত বই তার কাছে আছে। আমি তার কাজের জন্য স্যালুট জানাই।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুবর্ণা রানী সাহা জানান, ফেরিওয়ালা মিরাজুল হক যে কাজটি করছেন তা খুবই ভাল কাজ। পাঠাগারের জায়গার জন্য মিরাজুল যে আবেদন করেছেন সে বিষয়ে তিনি বলেন, আবেদনের বিষয়টি আমার চোখে পড়েনি। পুনরায় আবেদন করলে বিষয়টি আমি আন্তরিকতা সাথে দেখবো। পাঠাগারের জন্য সরকারি খাস জায়গা দেওয়া যায়কি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
খাস জমি আমরা দিতে পারি না। বন্ধোবস্ত নিতে হয়। আমরা মাত্র প্রস্তাব পাঠাতে পারি। কিন্তু খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার যে নিয়ম রয়েছে তা শুধুমাত্র সরকারিভাবে ভুমিহীন মধ্যে দেয়া হয়। আর পৌর সভার মধ্যে কোন জমি ভুমিহীনদের দেয়া হয়না। শুধুমাত্র ইউনিয়নে ভুুমিহীনদের মাঝে খাস জমি বন্দোবাস্ত দেয়া হয়।
কালীগঞ্জ পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ালীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নামের পাঠাগার সেহেতু আমাদের একটা দায়িত্বও আছে। এজন্য মিরাজুল হক কে পাঠাগারের জন্য আমি একটি অস্থায়ী অফিস দিয়েছিলাম। কিন্তু কি কারনে সেখানে পাঠাগারটি রাখেনি তা আমি জানিনা। তিনি আরো জানান, এমপি মহোদয়সহ আমরা যারা আছি তাদের সমন্বয়ে কাজটি করতে পারলে পাঠাগারটি স্টাবিলিস্ট হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সে নিজেই কমিটির সভাপতি। তারপর দেখবো কিভাবে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
Design and developed by zahidit.com